ভাড়াটে চাই
– নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
( নাটকটি ছোটো ও চরিত্রসংখ্যা কমানোর জন্য মূল নাটক থেকে সামান্য পরিবর্তন করা হয়েছে।)
চরিত্র
ভূপেন তলাপাত্র:
গাবলু:
রামরাম রাহা:
মিস্টার পুপ্ত:
কানাই:
কৃষ্ণদাস:
নন্তু:
সন্তু :
শাজাহান (পাগল):
বিশাখা :
শীলা :
এলা:
(একটি মাঝারি সাইজের হল ঘর। ঘরটি নূতন চুনকাম করা হয়েছে। দুতিনটে চেয়ার, একটা টেবিল – এ ছাড়া আর বিশেষ কোনো আসবাবপত্র নেই। সকাল সাতটা। বাড়ির মালিক ভূপেন তলাপাত্র এবং তাঁর দূর সম্পর্কের ভাইপো গাবলুর সঙ্গে কথা চলছে। গাবলুর হাতে দুটো খবরের কাগজ। ভূপেনের বয়েস আন্দাজ পঞ্চান্ন, পাকা গোঁফ-ঝানু চেহারা। গাবলুর বয়েস বছর পঁচিশ – চোখে-মুখে দুষ্টুমির ছাপ আছে।]
ভূপেন: বিজ্ঞাপনটা ঠিক মতন বেরিয়েছে তো গাবলু? সব বেশ খোলসা করে লিখেছিস?
গাবলু: সে আর বলতে হবেনা কাকা। একেবারে জ্বালাময়ী ভাষায় লিখে দিয়েছি। “ভাড়াটে চাই। একখানি অতি উত্তম মনোরম ঘর পূর্ব-দঙ্গিণ দিয়ে প্রচুর আলো-বাতাস আসে- ভাড়া অতি সুলভ। সত্ত্বর খোঁজ করুন। বত্রিশের সাত পাঁচুরাম গোলদার লেন—“
ভূপেন: অত লিখতে গেলি কেন? আবার বেশি পয়সা গেল একরাশ।
গাবলু: আহা – তুমি বুঝছনা কাকা। বড়ো মাছ ধরতে হলে ভালো করে টোপ ফেলতে হবে না ? কিন্তু – বলছিলুম কী– (ঘাড় চুলকোতে লাগল)
ভূপেন: (বিরক্ত হয়ে) কী – আবার কী বলবি ?
গাবলু: বলছিলুম, কেন নীচের তলা ভাড়া দিয়ে আবার বাইরের লোক ডেকে আনছ? তোমার তো টাকার অভাব নেই। জানোই তো, পাড়ায় একটা ভালো লাইব্রেরি নেই। ঘরটা যদি দিতে একটা লাইব্রেরি হ’ত –
ভূপেন: (দাত খিঁচিয়ে) লাইব্রেরি। আহা-হা – শুনে একেবারে অঙ্গ জল হয়ে গেল আমার! বলি, অ্যাঁ – ওই সমস্ত ছাই ভস্ম বই পড়ে কার কী উব্গারটা হবে ? খালি পাকামো শিখবি বই তো নয়। এই আমাকেই দ্যাখনা। পড়বার মধ্যে তো পড়ি খবরের কাগজে শেয়ারের দর। ব্যস – আর দেখতে হয় না ঈশ্বরের ইচ্ছায় মাসে – (থমকে) থাক সে কথা– কোথায় ইনকাম ট্যাক্সের লোক আবার থাবা পেতে আছে। হ্যাঁ – আর ওই তো তোদের হাবুল দত্ত। ফার্স্ট-ক্লাস এম-এ, বই পড়ে চোখ প্রায় কানা – মাসে পায় কত? কুল্লে তিন – সাড়ে তিন হাজার! লাইব্রেরি ফুঃ!
গাবলু : কিন্তু কাকা – লাইব্রেরি মানে জ্ঞান – জ্ঞান মানে আলো –
ভূপেন: থাম – বকিসনি! আলো! তাহলে তো হাবুল দত্তের ঘরে পাঁচশো পাওয়ারের লাইট জ্বলত। দেখে আয় না– ইলেক্ট্রিকের বিল দিতে পারেনি বলে কানেকশন কেটে দিয়েছে। যাঃ – এখন সরে পড় সামনে থেকে।
[ বাইরের থেকে ডাক এল “ভূপেনদা আছো – ও ভূপেনদা”। ]
মরেছে! সকালবেলায় আবার দাদা পাতাতে এলো কে? (সাড়া দিয়ে) আছি – ঢুকে পড়ো।
[ রামরাম রাহার প্রবেশ। বয়েস ভূপেনের মতোই হবেন। বেশ শৌখিন চেহারা – গিলে করা পাঞ্জাবি পরনে – গলায় চাদর। গোঁফটি সযত্নে দু’পাশে পাকানো।]
রামরাম: তারপর ভূপেনদা – সব ভালো? তোমার গেঁটে বাত এখন একটু ভালো? সামনের দুটো দাঁত নড়বড় করছিল– সে দুটো তুলে ফেলেছো তো? তোমার অম্বলের ব্যারামটা এখন–
ভূপেন: থামুন, থামুন, রামরামবাবু – একটু দম ফেলতে দিন তো। চিরকাল তো ‘আপনি’ আর ‘মশাই’ দিয়ে চালালেন হঠাৎ দাদা বুলি ধরেছেন যে বড়? ব্যাপার কী ?
রামরাম: এতকাল অপরাধ করেছি ভূপেনদা আজ সেটা টের পেলুম। হাজার হোক একটা মান্যিগণ্যি লোক পাড়ার মাথা জ্ঞানে বুদ্ধিতে –
গাবলু : রূপে, গুনে-
রামরাম: হ্যাঁ-হ্যাঁ, রূপে-গুনে, শৌর্যে-বীর্যে অদ্বিতীয় পুরুষ। শুধু দাদা কেন, ওকে তো-
গাবলু : ঠাকুর্দা বললেও অত্যুক্তি হয়না।
ভূপেন: চুপ কর বাঁদর কোথাকার, বেশি ওস্তাদী করিসনি । তা দেখুন রামারামবাবু, – আপনাকে তো আমার হাড়ে হাড়ে চেনা আছে মশাই। অকারণে এতখানি মধুবৃষ্টি করবেন সে পাত্র তো আপনি নন। মতলবটা কী খুলে বলুন দিকি?
রামরাম: ছিঃ ছিঃ, মতলব আবার কী থাকবে? পাড়া প্রতিবেশী একটু খবর নিতে আসা এই মাত্র । তা বলছিলুম কি আপনার এই ঘরটাই তো আপনি ভাড়া দেবেন?
ভূপেন: দেব বইকি! সেইজন্যই তো বিজ্ঞাপন দিয়েছি।
রামবাম: তাই এলুম।
ভূপেন: অঃ!
রামরাম: না–না– ইয়ে – ঠিক তা নয়। ভাবলুম মানে, দাদা হচ্ছেন পাড়ার মাথা – একবার সকালে খবরটা নিয়ে যাই মানে অম্বলের ব্যারামটা কেমন আছে দেখে আসি। আর বলছিলাম কি – মানে –
ভূপেন: অত আর মানে মানে করতে হবে না। ভাড়া নিতে চান এই তো? সোজা বললেই হয়!
রামরাম: হেঁ– হেঁ দাদার যেমন কথা! দাদা হলেন পাড়ার মাথা – আমাদের অভিভাবক – তাই ভাবছিলুম, উনি কি আর আমাদের কাছে ভাড়া চাইবেন? মানে, আমরা দশজন মিলে সন্ধ্যের দিকে একটু বসব, একটুখানি তাস-পাশা খেলা হবে – মানে, এক-আধটু গল্প-গুজব –
ভূপেন: বটে!
রামরাম : দেখছো তো দাদা দিনকাল! মানে, রকে বসে নিশ্চিন্তে একটু গল্প-গুজব করবারও জো নেই–সঙ্গে পুলিস এসে গুন্ডা আইনের হুড়ো লাগাবে। তা একটু বসবার জায়গা যদি পাই – মানে, একটু তাস-টাস —
গাবলু: খাসা আইডিয়া কাকা! লাইব্রেরি তো করতে দিলেনা এবার পাড়ার অকর্মাদের এনে তাসের আড্ডা বসিয়ে দাও।
ভূপেন: চোপ্ (চটে) কুঁড়ের বাথান। শিবের মন্দির পেয়েছেন – তাই নয়? সরে পড়ুন তো মশাই!
রামরাম: আমায় বলছো দাদা?
ভূপেন: খুব হয়েছে আর দাদাগিরিতে কাজ নেই। যান যান আমার আর সময় নষ্ট করবেন না।
রামরাম: কী! পাড়ার লোক আমরা– আমাদের অপমান করলেন? ঠিক আছে মশাই! লোহা দিয়ে তো মাথা বাঁধিয়ে আসেননি – মরবেনই একদিন। তখন দেখবো কে কাঁধ দেয়! হুঁঃ! ( রেগে বেরিয়ে গেল)
ভূপেন: কাঁধ দিয়েও তোমাদের দরকার নেই। তা হলে ভূত হয়ে এক একটার ঘাড় মটকাব আমি। অকর্মার ঢেঁকি সব। আমার বাড়িতে তাসের আড্ডা বসাতে এসেছেন! গাব্ লা-
গাবলু: কী কাকা?
ভূপেন: একটা কোঁতকা রেখে দে হাতের কাছে। এলেই তাড়া করবি।
গাবলু: কোঁতকা কোথায় পাব কাকা? তোমার রুপো বাঁধানো ছড়িটা নিয়ে আসব?
ভূপেন: খবর্দার খবর্দার, ও ছড়িতে হাত দিবিনি। ওই তো তোর রোগা পটকা ডিগডিগে চেহারা ফস্ করে কেউ কেড়ে নিলে দামী ছড়িটাই গেল!
[ সাহেবি পোষাক পড়া এক ভদ্রলোক প্রবেশ করলেন। রাশভারী চাল – মুখে চুরুট। সঙ্গে একটি পূর্ববঙ্গীয় চাকর, তাকে একটি উর্দি পরিয়ে এনেছেন সেটা গায়ে ঢলঢল করছে। ভদ্রলোকের নাম মিস্টার গুপ্ত চাকরের নাম কানাই।]
মিস্টার গুপ্ত: গুড মর্নিং-
গাবলু: আজ্ঞে হ্যাঁ– গুড মর্নিং-
মিস্টার গুপ্ত: মে আই নো– মানে আমি কি জানতে পারি – হু ইজ মিস্টার টলাপাটরো?
গাবলু: আজ্ঞে স্যার- টলাপাটরো তো কেউ নেই। তবে ইনি আমার কাকা ভূপেন তলাপাত্র।
মিস্টার গুপ্ত: আপনিই? সো গ্ল্যাড টু মিট ইউ।
[ এগিয়ে গিয়ে ভূপেনের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিলেন]
ভূপেন: উহু-হু-গেলুম গেলুম-
মিস্টার গুপ্ত: আই অ্যাম সরি – মানে আমি দুঃখিত – এক্সট্রিমলি সরি – অত্যন্ত দুঃখিত –
ভূপেন: দুঃখিত। আপনি তো দুঃখিত হয়েই খালাস– ইদিকে বেতো হাতটা আমার গেল। উঃ – উঃ-
মিস্টার গুপ্ত: কুড নট আন্ডারস্ট্যান্ড– বুঝতে পারিনি। এক্সকিউজ মী– মাপ করবেন। একটু আর্নিকা খেয়ে নেবেন সেরে যাবে। তা– আর ইউ গোইং টু রেন্ট দিস রুম? মানে আপনি কি এ ঘর ভাড়া দেবেন?
গাবলু: সেইজন্যেই তো পয়সা দিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে।
মিস্টার গুপ্ত: ওকে!-ওকে? কিরে কানাই – এ ঘর চলবে?
কানাই: আইজ্ঞা – তা ভালোই চলবো। (চারিদিকে দেখেশুনে) তবে আট দশটা খোপ কইরা দ্যাওন লাগবো।
ভূপেন: খোপ! কিসের খোপ?
কানাই: খোপ না হলে একলগে কুকুরগুলান থাকবো কেমন কইরা? কামড়া-কামড়ি কইরা কুরক্ষেত্তর বাধাইয়া দিবোনা? হঃ কি যে কন!
গাবলু: কুকুর? কুকুর কেন হে বাপু?
কানাই: কুকুর না তো কি কর্তা থাকবেন এই ঘরে? হঃ। কর্তার বালিগঞ্জে অত বড় বাড়ি – এই – ঘরে মরতে আইবেন কোন দুঃখে? হঃ কী যে কন! হাসাইলেন মশয়, নিতান্তই হাসাইলেন।
ভূপেন: সেকি! কুকুর রাখবার জন্য ঘর ভাড়া নিতে এসেছেন?
মিস্টার গুপ্ত: ক্যান্ট হেল্প, মানে উপায় নেই কিনা। আটটা কুকুর মশাই – দুটো গ্রেট ডেন, দুটো আলসেশিয়ান, দুটো টেরিআর, দুটো পিকিনিজ।
কানাই: বুঝলেন এই আটটায় মিল্যা যখন চিক্ষৈর দিতে আরম্ভ কোরবো। তখন ট্যার পাইবেন – সুখ কারে কয়। সেই জইন্যই তো মা-ঠারৈণ, থুড়ি মেম সাহেবের লগে বাবুর– থুড়ি, সাহেবের একেবারে রাম-বাবনের যুদ্ধ বাইধ্যা গেল। শ্যাষে মেম সাহেব একটা লাঠি নিয়া সাহেবেরে …
মিস্টার গুপ্ত: আঃ-থাক থাক! মানে দি পএন্ট ইজ–ইয়ে কথাটা হল – বাড়িতে একটু ডিস্টারবেন্স মানে গোলমাল হচ্ছে। তাই কুকুরগুলো এখানে থাকবে। একজন কীপার মানে চাকরও থাকবে।
ভূপেন: অ্যাঁ কুকুরকে ঘরভাড়া দেব!
কানাই: আইজ্ঞ না– কর্তারে। থুড়ি সাহেবরে। কাইল্ যদিও মেমসাহেব সাহেবরে কুকুর কইছেন – তাইলেও সাহেব কুকুর না- মানুষই।
মিস্টার গুপ্ত: আঃ – ইউ শাট্ আপ কানাই– তুই চুপ কর না। বলছিলুম কি – আই লাইক টু এনগেজ্ দিস্ রুম ফর মি – মানে আমি ভাড়া নেব। তাহলে আজ বিকেলেই-
ভূপেন: মাপ করবেন- কুকুর-টুকুর আমি এখানে রাখতে দেবোনা। আপনারা আসতে পারেন এখন। অ্যাঁ – বলে কি! আটটা কুকুর! কী ভয়ানক! কামড়ালেই তো জলাতঙ্ক।
গাবলু: বড়লোকের কুকুর কাকা। দাঁতে এ্যান্টিসেপটিক দেওয়া আছে- কিচ্ছু হবেনা।
ভূপেন: বকিসনি! না স্যার মাপ করবেন। এখানে কুকুর-টুকুরের সুবিধে হবেনা।
কানাই: ভুল করতে অছেন মশয় মহা ভুল করতে আছেন। এই সব কি যা-তা কুকুর পাইছেন আপনি? হঃ এরা রাস্তার নেরি কুত্তা না। এদের জইন্য মাসে পাঁচশো টাকা খরচ হয় সেইটা জানেন? পাইবেন তো শ্যাষে একটা কেরানী ভাড়াইট্যা! তার চাইয়া-
গাবলু: কেন বকে মরছ বাপু? হবেনা এখানে। তোমার সাহেব আর কুকুর নিয়ে আর কোথাও যাও – আমরা কোনো গরিব কেরানীকেই নয় ভাড়া দেব!
মিস্টার গুপ্ত: রট! চল কানাই-
কানাই: আইজ্ঞা, চলেন। ভুল করলেন মশয় মহা তুল করলেন। (দুপা গিয়ে মুখ ফিরিয়ে) ভাইব্যা দেখবেন ভালো কইরা, আমরা আবার আসব অখন –
গাবলু: আর আসতে হবেনা এতেই যথেষ্ট।
[ মিস্টার গুপ্ত ও কানাইয়ের প্রস্থান।]
ভূপেন: কান্ডটা দেখেছিস গাবলু? কি বেয়াক্কেলে লোক সব! বলে কিনা কুকুরের জন্যে ঘর ভাড়া নেবে। দুনিয়াটা দিনের পর দিন কি হচ্ছে বলদিকি?
গাবলু: যাচ্ছেতাই কাকা, যাচ্ছেতাই। তবে কি জানো, নেহাত প্রাণের দায়েই এসেছে! এদিকে কুকুর পুষে সাহেবি করার শখ, ওদিকে গিন্নির লাঠিতে দিশেহারা হয়ে ছুটে এসেছিল। তোমার দয়া হওয়া উচিত ছিল কিন্তু।
ভূপেন: দয়া। আমার বেতো হাতটায় এমন ঝাঁকুনি দিয়েছে যে সারা শরীর ঝনঝন করছে এখনো, উঃ- খুনে লোক! গাবলু।
গাবলু : কী বলছ?
ভূপেন: দোকান থেকে পাঁচ টাকার জিলিপি নিয়ে আয়। (একটা কয়েন দিলেন) বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে। (গাবলু যেতে উদ্যত) একটা ফাউ চেয়ে আনিস বুঝলি?
গাবলু : চেষ্টা করব (বেরিয়ে গেল)
ভূপেন: কুকুরের জন্যে ঘর ভাড়া নেবেন। শখ কত। দুনিয়ায় যে কত রকম মানুষ থাকে – আশ্চর্য! বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন দিয়ে তো ভারী ফ্যাসাদে পড়া গেল! আঃ- গাবলাটা আবার গেল কোথায়? জিলিপি আনতে গিয়ে বুড়ো হয়ে গেল নাকি?
[মুখে বিশৃঙ্খল দাড়ি – গায়ে ছেঁড়া জামা পাগলের প্রবেশ]
কে তুমি – কী চাও?
পাগল: আমি কে? হাঃ হাঃ হাঃ। আমাকে চেনো না মহব্বৎ খাঁ?
ভূপেন: মহব্বৎ খাঁ?
পাগল: দাঁড়ি রেখেছ আর ফতুয়া পরেছ বলেই তোমায় চিনতে পারবোনা – তুমি কি আমায় এতই নির্বোধ পেয়েছ মহব্বৎ খাঁ? বেল্লিক, তোমার এতবড় সাহস যে তুমি আমার সাধের তাজমহল ভাড়া দিতে চাও?
ভূপেন: কি বিপদ! পাগল দেখছি যে!
পাগল: চোপরাও বেতমিজ এখনই তোমার গর্দান নেব। কার সঙ্গে কথা কইছ জানো? জানো, আমি কে? সারে হিন্দোস্থানের বাদশা শাহেনশা শাজাহান। নাম তো শুনাই হোগা। দিনকতক আমি দাক্ষিণাত্যে ভ্রমণে বেরিয়েছি – সেই ফাঁকে তুমি আমার এই সাধের তাজমহলে ভাড়াটে বসাতে চাও! ইলহমদলিল্লাহ!
ভূপেন: আঃ- কী বিপদ! যা – যা – রাস্তায় যা।
পাগল: রাস্তায়? আমার এই তাজমহল ছেড়ে? ইনসাল্লাহ! বেওকুফ – এখনি তোমায় কতল্ করে ফেলব। (চিৎকার করে) দেলোয়ার খাঁ- দেলোয়ার খাঁ-
[ জিলিপির ঠোঙা হাতে গাবলুর প্রবেশ।]
পাগল: এই যে এসেছ দেলোয়ার খাঁ? এই উজবুক মহব্বতের গর্দান নাও! এক্ষুনি! (গাবলু হাঁ করে রইল। পাগল হঠাৎ ছোঁ মেরে তার হাত থেকে জিলিপির ঠোঙা কেড়ে নিলে) কী এনেছ ? রাজভোগ? আচ্ছা আগে খেয়ে আসি তারপর মহব্বতের বিচার করব!
[ ঠোঙা থেকে জিলিপি খেতে খেতে প্রস্থান]
ভূপেন: (আর্তনাদ করে) নিলে নিলে! পাঁচ টাকার জিলিপি নিয়ে চলে গেল! ধর ধর-
[ গাবলু দরজা পর্যন্ত দৌড়ে গিয়ে উঁকি মেরে দেখল]
গাবলু : ধরবার আর জো নেই কাকা-ট্রামে উঠে পড়েছে!
ভূপেন: (ক্ষেপে গিয়ে) পাঁচ টাকার জিলিপি কেঁড়ে নিয়ে গেল আর তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলি? অ্যাঃ?
গাবলু : দেখবার আর সময় পেলুম কই? ঘরে ঢুকতেই তো মহব্বৎ-দেলোয়ার কী সব বলে- টলে খপ করে ঠোঙা কেড়ে নিলে। কে ও কাকা?
ভূপেন: (দাঁত খিঁচিয়ে) সম্রাট শাজাহান।
গাবলু: শাজাহান!
ভূপেন: হাঁ হাঁ – শাজাহান! তার তাজমহল ভাড়া দিচ্ছি তাই গর্দান নিতে এসেছিল! সকালবেলাতেই- ই কি পাগলের কান্ড রে। আমাকে শুদ্ধ পাগল করে দিয়ে গেল!
গাবলু: আবার জিলিপি নিয়ে আসব কাকা?
ভূপেন: থাক ঢের হয়েছে আর দরকার নেই। (তাকিয়ে) এরা আবার কারা?
[ একটি দম্পতি প্রবেশ করলেন। দুজনেই প্রৌঢ় বয়সের। স্বামীটি রোগা গলায় তুলসীর মালা, গো-বেচারা টাইপ; স্ত্রীটি একটু জাঁদরেল গোছের]
আপনারা?
স্বামী: হরে কৃষ্ণ। অধমের নাম হচ্ছে সেবক কৃষ্ণদাস দাস। ইনি হচ্ছেন আমার সহধর্মিনী বৈষ্ণবী বিশাখা দাসী। আমরা আপনার ঘরটি ভাড়া নিতে এসেছি।
ভূপেন: (খুশি হয়ে) বেশ, বেশ। বসুন।
কৃষ্ণদাস: আজ্ঞে বসবার দরকার নেই দাঁড়িয়েই কথাটা শেষ করি। বুঝলেন আমরা স্বামী – স্ত্রী – একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট! ছেলেপুলে নেই। একটু শান্তিতে সাধন-ভজন করতে চাই। তাই আসা।
ভূপেন: (আরও খুশি হয়ে) সে তো ভালো কথা- আমিও নির্ঝঞ্ঝাট ভাড়াটেই চাই, ভাড়া কিন্তু চারশ টাকা।
কৃষ্ণদাস: তা হোক- তা হোক। শ্রী কৃষ্ণের ইচ্ছায় ব্যবসা বাণিজ্য আছে তেজারতি করে থাকি – আপনাকে ছ’মাসের ভাড়া আগাম দেব। কথাটা কি জানেন- আমরা একটু শান্তিতে থাকতে চাই আর কিছু নয়।
ভূপেন: তাতে কোনো অসুবিধা হবে না। আমাদের এখানে কোন গোলমালই নেই। (গাবলুকে) ঘরটা এঁদেরই দেওয়া যাক – কী বলিস গাবলু?
গাবলু : (মুখ ভার করে) তোমার ঘর তুমি যা ইচ্ছে করো আমার কী বলবার আছে?
ভূপেন: কৃষ্ণদাস বাবু তাহলে সব দেখে শুনে নিন। ওপাশে কলঘর, ওদিকে ছোটো বারান্দা – ওখানে রাঁধতে পারবেন –
কৃষ্ণাদাস: বাঃ- কৃষ্ণের ইচ্ছেয় সব তো ভালোই দেখছি। আমরা শান্তি চাই- এমনি একটা জায়গায়ই তো খুঁজছিলুম। ওগো কী বলো? এতেই তো আমাদের কুলিয়ে যাবে?
বিশাখা: (ভাঙা মোটা গলায়) কুলোতেই হবে। এর চাইতে বড় বাড়ি তো আর নেবেনা তুমি- যা হাড়কেপ্পন !
কৃষ্ণদাস: হেঁ হেঁ- বোঝোনা অপব্যয় কী ভালো? অল্পের মধ্যেই শান্তিতে থাকতে হয়। তা হলে – (জানলার কাছে গিয়ে) এখানেই আমাদের শোয়ার খাট পড়বে-
বিশাখা: আ-মরণ – কী বুদ্ধি! জানলার কাছে শোবো আর রাত্তিরে চোরে আমার গয়না ধরে টান দিক! খাট থাকবে ও-পাশে।
কৃষ্ণদাস: ও-পাশে! ওদিকে জানলা নেই যে! গরমে প্রাণ যাবে।
বিশাখা: কী আমার শখের প্রাণ গড়ের মাঠ রে। একটু গরমেই প্রাণ যাবে! না – খাট ওখানেই থাকবে।
কৃষ্ণদাস: আমি বলি, খাট এদিকেই থাক।
বিশাখা: খবরদার বলছি (গলা চড়ল) খাট সরিয়েছ কি খুনো-খুনি হয়ে যাবে!
ভূপেন: আহা-হা- কেন আপনারা আগে থেকেই ঝামেলা করছেন? আগে সব ঠিক হোক- জিনিসপত্তর নিয়ে আসুন, তারপর না হয় ঠিক করবেন খাট কোথায় থাকবে।
বিশাখা: (প্রচন্ড ধমক দিয়ে) তুমি চুপ করো তো বাপু। এমন বেয়াক্কেলে আহাম্মক লোক তো কখনো দেখিনি! স্বামী-স্ত্রী কথা কইছি তার মধ্যে ফোড়ন কাটতে এসেছ!
ভূপেন: ওরে বাবা!
গাবলু : কাকা- থেমে যাও। ওরা স্বামী স্ত্রী শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনা করছেন। তুমি আর ওর মধ্যে নাক গলাবার চেষ্টা কোরোনা। তাতে নাক ভাঙতে পারে।
কৃষ্ণদাস: আমার ইচ্ছে- খাট এখানেই থাকবে।
বিশাখা: কক্ষনো না খাট ওপাশে থাকবে।
কৃষ্ণদাস: সাবধান বিশাখা আমি তোমার স্বামী। পতি পরম গুরু। আমার মুখে মুখে তর্ক করো না- নরকে যাবে।
বিশাখা: তবে বে হতচ্ছাড়া-তক্কো করব না! ভেবেছ অন্যের বাড়িতে এসেছে–এখানে যা খুশি আমায় তাই বলতে পারবে? দাঁড়াও দেখাচ্ছি তোমায়! (গাছকোমর বাঁধতে বাঁধতে) বাড়ুন – একগাছা বাড়ুন পাই কোথায়? ওইতো কলতলায় মুড়ো ঝাঁটা একখানা আছে দেখছি – (বেগে ভূপেনের অন্দরের দিকে প্রস্থান)
ভূপেন: আহা-হা–একি করছেন-একি করছেন!
গাবলু : ওরা শান্তি চান কাকা তারই মহড়া দিচ্ছেন।
(কৃষ্ণদাস এর মধ্যে সরে পড়েছেন)
বিশাখা: (কলতলা থেকে) কই, কোথায় মুখপোড়া আজ তোরই একদিন কি আমারি একদিন–
গাবলু: কাকা-পর্বতো বহ্নিমান ধূমাৎ-পালাও –
(গাবলু পালালো; ভুপেন পালাবার অন্য রাস্তা না পেয়ে চট করে টেবিলের তলায় ঢুকলেন)
বিশাখা: (ঢুকে) কই- কোথায় গেল মুখপোড়া মিনসে? খাট কোথায় থাকবে দেখিয়ে দিচ্ছি এখুনি। গেল কোথায়? (টেবিলের তলায় ভূপেনকে দেখে) অ্যাঁ ওখানে পালিয়েছ? ভেবেছো টেবিলের তলায় ঢুকে আমার হাত থেকে বাঁচবে? (কাছে গিয়ে এক ঘা বসিয়ে) এইবার? খাট কোথায় থাকবে? অ্যাঁ? (আর এক ঘা বসিয়ে) বলি কোথায় থাকবে খাট?
ভূপেন: ওরে বাপরে গেলুম রে! থানা – পুলিশ – চৌকিদার-
বিশাখা: চৌকিদার তোমায় দেখাচ্ছি। (আর এক ঘা) বলি, খাট থাকবে কোথায়? জবাব দাও কোথায় থাকবে খাট?
ভূপেন: বাপ-রে- মা-রে গেছিরে ও মা লক্ষ্মী আমি নই আমি নই-
(গাবলু দৌড়ে এল)
গাবলু : ও কাকে মারছেন? (ইতিমধ্যে আর এক ঘা বসিয়েছেন বিশাখা) আরে উনি যে বাড়িওয়ালা – আমার কাকা! আপনার সেবক কৃষ্ণদাসবাবু এখন সোজা বড়ো রাস্তা দিয়ে দৌড় মেরেছেন-
বিশাখা: দৌড়ে যাবেন কোন চুলোয়? আমার খপ্পরেই পড়তে হবে শেষ পর্যন্ত। দেখছি আমি খাট কোথায় থাকে – (ছুটে বেরিয়ে গেল)
ভূপেন: (টেবিলের তলা থেকে) বাবারে, গেছিরে হাড় গুড়ো করে দিয়েছে রে।
গাবলু : বেরোও কাকা, নির্ভয়ে বেরিয়ে এসো এখন। অল্ ক্লিয়ার!
ভূপেন: উহু-হু আটকে গেছি যে! বেরুতে পারছিনা! উরে বাবারে-
(গাবলু টেনে ভূপেনকে বের করলে)
গাবলু : বড্ড লেগেছে কাকা? ডাক্তার ডাকব?
ভূপেন: দরকার নেই- কাটা ঘায়ে তোকে আর নুনের ছিটে দিতে হবেনা | উরিঃ বাব্বা পিঠে আর কিছু রাখেনি! চিড়বিড় করে জ্বলছে! শান্তির সংসার–তাই বটে! নির্ঝঞ্ঝাট! ওফ!
গাবলু: ঝঞ্ঝাট নেই বলে যে ঝাঁটা থাকবেনা এমন কথা তো শাস্ত্রে লেখা নেই কাকা।
ভূপেন: তোকে আর রসিকতা করতে হবে না! ইদিকে আমার প্রাণ যায়। এক গ্লাস জল নিয়ে আয় দেখি চট করে।
(গাবলু জল নিয়ে এল।)
ভূপেন: বাড়ি ভাড়া দিতে গিয়ে একি জ্বালাতনে পড়লুম রে গাবলা।
গাবলু : তাই তো বলছিলুম কাকা ঘরটা আমাদের লাইব্রেরিকেই দান করে দাও। তোমায় তো টাকার অভাব নেই। না হয় মাসে চারশ টাকা ইন কাইন্ড আমাদের ডোনেশনই দিলে। আমরা অকৃতজ্ঞ নই। লাইব্রেরির নাম দেব “ভূপেন্দ্র-পাঠাগার”।
[গাবলুর বন্ধু নন্তু ও সন্তুর প্রবেশ; সন্তুর হাতে একটা ভাঁজ করা শালুর মোড়ক]
নন্তু: নিয়ে এসেছি।
সন্তু: খুব ভালো করে লিখেছি কাকা। “ভূপেন্দ্র-পাঠাগার” –
[ সন্তু হাতের শালুর মোড়ক খুলল তাতে সত্যিই বড়ো বড়ো সাদা হরফে লেখা” ভূপেন্দ্র-পাঠাগার “]
নন্তু: তাহলে এটা বাইরে টাঙিয়ে দিই কি বলিস গাবলু?
ভূপেন: (চটে) বটে! মামা বাড়ির আবদার পেয়েছ তাই না? আমি বেঁচে থাকতেই “ভূপেন্দ্র পাঠাগার”! লাইব্রেরি! নিকালো হিয়াসে-
সন্তু: আপনি বুঝতে পারছেন না কাকা। সত্যিই এতে পাড়ার ছেলেদের উপকার হবে। আমরা অনেকগুলো বইও জোগাড় করেছি শুধু যদি আপনার ঘরটা পাই-
ভুপেন: দিচ্ছি ঘর! এ-সবই গাবলার কারসাজি। লাইব্রেরি করবে। (মুখ ভেঙচে) পিন্ডির ব্যবস্থা হবে আমার।
নন্তু: কিন্তু কাকা-
ভূপেন: শাট আপ! ভাগো হিয়াসে! চালাকির আর জায়গা পাওনি!
[ সন্ত-নন্তর সভয়ে প্রস্থান।
খবরদার গাবলু! ফের যদি লাইব্রেরির নাম করবি তো তোর কান উপড়ে নেব। মনে থাকে যেন আমার কথা!
[ গাবলু গোঁজ হয়ে রইল। রামরাম রাহা আবার এসে উপস্থিত হলেন।
এই যে- ফের এসেছেন! আবার কি জন্যে শুনি?
রামরাম: কী আর করি। দাদা হচ্ছেন পাড়ার মুরুব্বি দাদার ওপর তো আর অভিমান করা যায়না। বলছিলুম কি ঘরটা তাহলে তুমি আমাদেরই দিচ্ছ? মানে সন্ধ্যেবেলায় সবাই একটু বসা, দুহাত তাসপাশা খেলা-
ভুপেন: আপনি তো দেখছি ছিনে জো’ক মশাই! লজ্জা-সরমের বালাই নেই?
রামরাম: শাস্ত্রেই তো আছে দাদা ঘৃণা-লজ্জা ভয়-তিন থাকতে নয়! আমার নিজের জন্যে কি আর বলছি? এই পাড়ার দু’চারজন আসবে একটু বসবে –
ভূপেন: টেক কেআর রামরাম বাবু, ধৈর্যের একটা সীমা আছে। এর পরে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেব!
রামরাম: কী ঘাড় ধাক্কা দেবেন? (রেগে তোতলা হয়ে গেলেন) বা-বা বাড়িতে পেয়ে যা খ-খ খুশি আপমান ক-ক করলেন! যদি এর শ শ শোধ নিতে না পারি, তবে আ-আ-আমার নাম রা- রা-রা-রামরাম রা-রা-রাহাই নয়। (বেগে প্রস্থান)
ভূপেন: ওরে গাবলা – কী ডেঞ্জারাস জীব! শাসিয়ে গেল! লোকটা যে এমন পাখোয়াজ সে তো জানতুম না।
গাবলু: ঘরটা যদি লাইব্রেরিকে দিতে কাকা তাহলে এসব পাখোয়াজ মৃদঙ্গের কোনো ঝামেলাই হ’ত না। তোমার জিলিপির ঠোঙা গেল, খামোকা ঝাঁটার ঘা খেলে –
ভূপেন: চোপরাও! আমি ঝাঁটার ঘা খেয়েছি বলে তোর খুব ফুর্তি হয়েছে-না?
[শীলা, এলার প্রবেশ]
শীলা: নমস্কার। আমরা একবার ভুপেনবাবুর দেখা পেতে পারি কি?
ভূপেন: আমিই ভূপেন। আপনাদের কী চাই মা- লক্ষ্মীরা?
এলা: আপনার এই ঘরটি তো ভাড়া দেবেন? (চারদিক দেখে শুনে) তা মন্দ হবেনা এতেই কুলিয়ে যাবে। বেশ লম্বা আছে ঘরটা।
ভূপেন: ঘর ভাড়া নেবেন মা-লক্ষ্মীরা? তা আপনাদের সঙ্গে পুরুষ কই? কার সঙ্গে কথা কইব?
শীলা : পুরুষের দরকার কী আমাদের সঙ্গেই কথা বলুন। আমরাই আমাদের গার্জেন।
ভূপেন: আঃ
শীলা: তা আগে পরিচয়টা দিয়ে নিই। আমি হচ্ছি শীলা চক্রবর্তী। খুব ভালো জাপানিজ নাচ জানি। এ হচ্ছে এলা দত্ত – সমস্ত ফোক ড্যান্সে এক্সপার্ট। মনিপুরী থেকে শুরু করে রায় বেঁশে পর্যন্ত সব জানে।
ভূপেন: (ঘাবড়ে) অঃ! বেশ বেশ!
শীলা : শুনুন, আমরা এখানে একটা নাচের ইস্কুল করব।
ভূপেন: নাচের ইস্কুল! সে কি কথা! নাচের আবার ইস্কুল কী। না-না এখানে ও সমস্ত হতে পারেনা!
এলা: কেন পারেনা আলবৎ পারে। নাচের মতন কি জিনিস আছে? এক্সারসাইজ বলুন এক্সারসাইজ, এন্টারটেনমেন্ট বলুন এন্টারটেনমেন্ট মানে এক কথায় নাচই হচ্ছে জাতির ভবিষ্যৎ। তবে ভাড়া-টাড়া আমরা দিতে পারবো না কিন্তু-
গাবলু: কাকা-নিশ্চিন্দি! এঁরা নাচের ইস্কুল করবেন ভাড়াও দেবেন না।
ভূপেন: (ভয় পেয়ে) না না এখানে নয়, এখানে নয়। আপনারা আর কোথাও দেখুন।
শীলা: আর কোথায় দেখব এই ঘরটাই আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছে। ভাবনা কি – ভাড়া না পেলেও আপনি ঠকবেন না। আপনার মেয়েদের পাঠিয়ে দেবেন ফ্রীতে নাচ শেখাব।
ভূপেন: মেয়ে-টেয়ে আমার নেই। আপনারা –
শীলা: মেয়ে না থাকে আপনার স্ত্রীকেই শেখাব এখন।
গাবলু: কাকীমাকে নাচ শেখাতে গেলে আপনাদের আর একটু দূরে যেতে হচ্ছে! মানে তিনি ইহলোকে নেই কিনা! আপনাদের স্বর্গ পর্যন্ত ধাওয়া করতে হবে।
এলা: বেশ তো – তা হলে ভূপেনবাবুই শিখবেন! (গাবলু হাঁ করল।)
ভূপেন: (বজ্রাহত) অ্যাঁ আমি!
শীলা: ক্ষতি কী! একটু বুড়ো ভুঁড়িও আছে তা হলেও বেশ নাচতে পারবেন। নাচের কি কোনো বয়েস আছে? এটা তো এক্সারসাইজ। ইউরোপে গিয়ে দেখুন আশি বছরের বুড়োরাও দিব্বি নাচছে। ওতে চমৎকার স্বাস্থ্য থাকে। আপনার ভুঁড়িও কমে যাবে।
এলা: একে রায়বেঁশে শিখিয়ে দেব। বাঙালীর নিজস্ব নাচ। এখুনি একটু তালিম দিতে পারি “আমরা নাচব রায় বেঁশে (সুরে) মোদের ভাবনা ভয় কিসে-।” ‘এক-দুই-তিন-চার দেখুন না- এমনি করে পা ফেলবেন – এক-দুই-তিন–.
ভূপেন: বাবারে গেছি (আঁতকে পড়ে গেলেন)
এলা-শীলা: কী হল? কী হল? হঠাৎ পড়ে গেলেন কেন?
গাবলু : ওর হার্টের অবস্থা খুব খারাপ আপনাদের নাচ শেখানোর প্রস্তাবেই-
এলা-শীলা: (সমস্বরে) অ্যাঁ হার্টের অবস্থা খুব খারাপ। অজ্ঞান হয়ে গেলেন! কী সাংঘাতিক!
[ পালালো। ভূপেন মেজেতে পড়ে রইলেন কাঠ হয়ে।]
গাবলু: কাকা-উত্তিষ্ঠতঃ-জাগ্রতঃ। তোমার পতন ও মূর্ছাটা খুব কাজ দিয়েছে।
ভূপেন: ওফ!
গাবলু: (ভূপেনকে টেনে ওঠালো) উঠে পড়ো কাকা ওরা চালে গেছেন। হাজার হোক মায়ের জাত তো, অল্পেই দয়া করেছেন।
ভূপেন: একটা ফাঁড়া কাটলরে গাবলা! এই বুড়ো বয়েসে আমাকে নাচাতে এসেছে? আর একটু হলেই যে মহাপ্রাণটি বেরিয়ে যেত!
গাবলু : সবে তো কলির সন্ধ্যে, কাকা! লাইব্রেরি যদি — সে থাক, কাকা তুমি ভেতরে গিয়ে এক ঘটি জল খেয়ে খানিকক্ষণ জিরোওগে। আমি ততক্ষণ এদিকটা সামলাই।
ভূপেন: তা মন্দ বলিসনি আমার বুক ধড়ফড় করছে এখনো। কী ভয়ঙ্কর-এই বয়েসে আমাকে নাচাতে চায়! ঘর ভাড়া দিতে গিয়ে খুব আক্কেল হয়েছে আমার। ওফ্! একটু চা খাই গে-
(ভূপেন ভেতরে গেলেন। গাবলু চেয়ারে বসে খবরের কাগজের পাতা ওল্টালো।)
(ঠিক এই সময় একে একে ঘরে ঢুকলো রামরাম, কৃষ্ণদাস, বিশাখা, শীলা,এলা।)
ভূপেন : কীসের হইচই রে গাবলা ? (সকলের উদ্দেশ্যে) মগের মুলুক পেয়েছো সব। বেরোও সব এখান থেকে।
(ঠিক এ সময় দাড়িওলা একটি লোক একটা ব্যাগ হাতে ঘরে ঢুকলো।)
দাড়িওলা লোক: (ঢুকেই চিৎকার করে) সরে যান – সরে যান সব – আমায় একটু শুতে দিন কোথাও । আমার খুব জ্বর, আর দাঁড়াতে পারছিনা ! নাকে কোনো গন্ধও পাচ্ছি না।
কৃষ্ণদাস : কে আপনি? জ্বর হয়েছে তো এখানে কেন? হাসপাতালে যান না।
দাড়িওলা: আমি গৌহাটি থেকে আসছি। ওখানে করোনার প্রকোপ খুব বেড়েছে বলে পালিয়ে এসেছি। মাথায়, বগলে খুব ব্যথা। ব্যাগের ভেতরে করোনা পজিটিভের রিপোর্ট ভরা আছে। হোটেলে ছিলুম – সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলে। সরুন-সরুন শিগগির- শুতে দিন আমাকে – ভারী জ্বর এসেছে সরুন, নইলে যেখানে সেখানেই ধপাৎ করে শুয়ে পড়ব কিন্তু –
রামরাম: অ্যাঃ – জ্বর – গায়ে বাথা!
মিস্টার গুপ্ত : কাম ফ্রম গৌহাঠি !
দেয়ার ইজ এ কোভিড পজিটিভ রিপোর্ট ইন দ্য ব্যাগ।
কৃষ্ণদাস : করোনা ! কী ভয়ানক! আর এক মুহূর্ত এখানে নয়। হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা – অন্য কোনোখানে (পলায়ন)
কানাই : অ্যাঁ, বুড়ো বয়সে করোনায় মারা পইড়ব !
দাড়িওলা : সরুন, সরুন কারো গায়েই শুয়ে পড়ব এখুনি –
(ঊর্ধ্বশ্বাসে সবাই ছুটল। )
ভূপেন: হায় হায়-আমার কী হ’ল। শেষে আমার ঘরে এসে করোনার রুগী ঢুকল! এবার যে সবংশে মারা যাব ! হায় – হায় – হায়
গাবলু : (কাছে এসে) কোনো ভয় নেই কাকা, ও করোনার রুগী নয়। ও নন্তু ।
ভূপেন: অ্যাঁ। নন্তু !
নন্তু: (একটানে দাড়ি খুলে ফেলল) কী করব কাকাবাবু এ নইলে আপনাকে যে বাঁচানো যেতনা। ঘর ভাড়ার নামে সবাই যে কান্ড কারখানা শুরু করেছিল।
[ সন্তু এসে ঢুকলো। ]
ভূপেন: বাঁচালে বাবারা আমায় বাঁচালে। কিন্তু ওই ব্যাগে –
সন্ত: কোভিড পজিটিভের রিপোর্ট নেই কাকা। কী আছে দেখবেন?
(ব্যাগ খুলল। বেরিয়ে এল সেই লাল শালুটি- “ভূপেন্দ্র পাঠাগার”)
গাবলু : কাকা – তাহলে এটা-
ভূপেন: টাঙিয়ে দে – দরজার সামনে টাঙিয়ে দে ! আর তলায় লিখে দে – বাড়ি ভাড়া হইয়া গিয়াছে !
নন্ত সন্ত: (আনন্দে) কাকা!
ভূপেন: বাড়ি ভাড়া দিতে গিয়ে খুব শিক্ষে হয়েছে আমার। ঝাঁটার ঘা থেকে শুরু করে কিছুই তো আর বাকি রইলো না। তোদের লাইব্রেরিই হোক। সেইটেই দেখছি সবচেয়ে নিরাপদ।
গাবলু: থ্রি চিয়ার্স ফর ভূপেন কাকা –
নন্তু-সন্তু: হিপ, হিপ হুররে –
সমাপ্ত
‘ভাড়াটে চাই’ নাটকটি ডাউনলোড করার জন্য নীচে ক্লিক করুন 👇