বাংলা ভাষা
ধ্বনিতত্ত্ব
ভূমিকা :
সাধারণভাবে বলা যায় যে, ভাষাবিজ্ঞানের যে অংশে ধ্বনি সম্পর্কে আলোচনা হয়, তাকেই ধ্বনিতত্ত্ব বলে। মানুষের বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনিই শুধু আলোচ্য। হাসি, কান্না, হাঁচি, নাকডাকা, ভয়ের চিৎকার অথবা বৃষ্টির শব্দ, ঝড়ের আওয়াজ, গাড়ির হর্ণ, কুকুরের ডাক ইত্যাদি sound বা শব্দ হলেও কিন্তু ধ্বনি বলে গণ্য নয়। সমস্ত আওয়াজ যে বাগধ্বনি নয় এবং কোন ধ্বনিগুলি ভাষার ঠিক কোনখানটায় বাগধ্বনি হয়ে ওঠে সেগুলো নিয়েই এখনকার আলোচনা।
ধ্বনিতত্ত্ব কিন্তু বর্ণ বা লেখার ব্যাপার নিয়ে একটুও মাথা ঘামায় না। ধ্বনিতত্ত্বের আলোচ্য বাধ্বনি, অর্থাৎ মুখের ভাষা বা মুখের কথা। ধ্বনি, শব্দ বা পদ ইত্যাদি হল ভাষা শরীরের এক-একটি স্তর। সবচেয়ে নীচে ধ্বনিস্তর, তার ওপরে রূপস্তর, তার ওপরে পদ, তার ওপরে বাক্যস্তর, আরও আছে অর্থের স্তর। ভাষার ধ্বনিস্তর নিয়ে আলোচনার নাম ধ্বনিতত্ত্ব। এখানে বাগধ্বনি সম্বন্ধে তিনটে জরুরি কথা মনে রাখা দরকার।
(১) আমরা মনে রাখব যে যদিও ধ্বনিখণ্ডের চেয়ে ধ্বনিপ্রবাহের বাস্তবতা অনেক বেশি তবুও বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে ব্যাকরণের গন্ডিতে আমরা খণ্ডধ্বনিকেই গুরুত্ব দেবো। খণ্ডধ্বনির নাম বিভাজ্যধ্বনি।
(২) ধ্বনিতত্ত্বের আলোচ্য একক বাগধ্বনি হল ভাষার অর্থহীন এবং ক্ষুদ্রতম একক। আবার এও মনে রাখতে হবে অর্থহীন হলেও ভাষার মানে তৈরির এলাকায় এর ভূমিকা অপরিসীম।
(৩) আমরা ধ্বনি উচ্চারণ করে মুখে যা বলি তা বাংলা লিপির বর্ণ ব্যবহার করে লিখেও ফেলি। কিন্তু এই ধ্বনি ও বর্ণের পারস্পরিক সম্পর্কটা খুব সরল নয়।
ধ্বনিতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়:
ধ্বনিতত্ত্বের আলোচ্য বিষয় হল একটি নির্দিষ্ট ভাষার বাগধ্বনির ব্যবহারিক চরিত্র। ভাষাবিজ্ঞানের দুটি শাখায় বাগধ্বনি নিয়ে আলোচনা করা হয়- ধ্বনিবিজ্ঞান ও ধ্বনিতত্ত্ব। ধ্বনিবিজ্ঞান বাগধ্বনির উচ্চারণগত, শ্রুতিগত ও ধ্বনিতরঙ্গগত বিশ্লেষণ করে। আর ধ্বনিতত্ত্ব একটি ভাষার বাগধ্বনিগুলি সেই ভাষায় কীভাবে ব্যবহৃত হয় তা বিশ্লেষণ করে।
ধ্বনিবিজ্ঞান ও ধ্বনিতত্ত্বে আলোচনার ধরন :
ধ্বনিবিজ্ঞান ধ্বনি বিশ্লেষণ করে -উচ্চারণগত, ধ্বনিতরঙ্গগত, শ্রুতিগত ।
ধ্বনিতত্ত্ব ধ্বনি বিশ্লেষণ করে – নির্দিষ্ট ভাষায় ধ্বনির ব্যবহারিক চরিত্র ।
বাগধ্বনি প্রধানত দু-ধরনের- বিভাজ্যধ্বনি ও অবিভাজ্যধ্বনি। বিভাজ্যধ্বনির দুটি মূল ভাগ- স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি। অবিভাজ্যধ্বনির মধ্যে পড়ে দৈর্ঘ্য, শ্বাসাঘাত, যতি ও সুরতরঙ্গ।
স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি
আন্তর্জাতিকভাবে ভাষাবিজ্ঞানীদের দ্বারা স্বীকৃত মৌলিক স্বরধ্বনি বা Cardinal vowels হল বিভিন্ন ভাষার স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় জিহ্বার অবস্থান ও ওষ্ঠের আকৃতি বুঝিয়ে দেবার মানদণ্ড। অধ্যাপক জোন্স মৌলিক স্বরধনিকে ‘Scales of Cardinal Vowels’ বলেছেন। ধ্বনিবিজ্ঞানী অ্যাবাক্রম্বে কে অনুসরণে বলা যায়-বিভিন্ন ভাষার স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় জিহ্বার অবস্থান চিহ্নিত করার জন্য মুখের ভিতরের শূন্যস্থানে ভাষাবিজ্ঞানীরা যে-সব কাল্পনিক মাপকাঠি করেছেন তাদের বিভিন্ন পরিমাপ-নির্দেশক বিন্দু থেকে উচ্চারিত স্বরধ্বনিগুলিকে মৌলিক স্বরধ্বনি বলে।
আমরা বাংলা স্বরধ্বনিগুলির মধ্য থেকে ৭ টি স্বরধ্বনি পেলাম যা মান্য বাংলা স্ববধ্বনি হিসাবে চিহ্নিত।


স্পর্শ ধ্বনি- ক্ থেকে ম্ পর্যন্ত পঁচিশটি ধ্বনি।
অল্পপ্রাণ ধ্বনি- বর্গের প্রথম ও তৃতীয় ধ্বনিগুলি। যথা ক্ গ্, চ্ জ্, ট্ ড্, ত্ দ্, প্ ব্।
মহাপ্রাণ ধ্বনি- বর্গের দ্বিতীয় ও চতুর্থ ধ্বনিগুলি। যথা খ্ ঘ্, ছ্ ঝ্, ঠ্ ঢ্, ত্ ধ্, প্ ভ্।
অঘোষ ধ্বনি- বর্গের প্রথম ও দ্বিতীয় ধ্বনিগুলি। যথা ক্ খ্, চ্ ছ্, ট্ ঠ্, ত্ থ্, প্ ফ্।
ঘোষ ধ্বনি- বর্গের তৃতীয় ও চতুর্থ ধ্বনিগুলি। যথা – গ্ ঘ্ , জ্ ঝ্ , ড্ ঢ্ , দ্ ধ্, ব্ ভ্।
নাসিক্য ধ্বনি- প্রত্যেক বর্গের পঞ্চম ধ্বনিগুলি। যথা ঙ্, ঞ্, ণ্, ন্, ম্।
উষ্মধ্বনি শ্, ষ্, স্, হ্।
কম্পিত ধ্বনি – র্।
তাড়িত ধ্বনি – ড়, ঢ়্।
পার্শ্বিক ধ্বনি – ল্।
বাংলা উচ্চারণে চারটি অর্ধস্বরধ্বনি আছে। এগুলির জন্য বাংলার কোনো বর্ণ নির্দিষ্ট নেই। খই, বউ, আয়, যাও- এই চারটি শব্দ যে যে অসম্পূর্ণ স্বরধ্বনির উচ্চারণে শেষ হয় সেই চারটি অর্ধস্বর, যদিও বাংলা অর্ধস্বর নিয়েও বিতর্ক আছে।
ধ্বনিমূল ও সহধ্বনি
ধ্বনিতত্ত্বের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হল ধ্বনিমূল ও সহধ্বনি। বাংলা বলার সময়ে আমরা যতগুলি ধ্বনি উচ্চারণ করি সবকটিকেই সাধারণভাবে ধ্বনি বলা হলেও ভাষায় আসলে এগুলি দু-ধরনের ভূমিকা পালন করে- ধ্বনিমূলের বা সহধ্বনির। ধ্বনিতত্ত্বের রীতি মান্য করে আমরা ধ্বনিমূলকে দুটি বাঁকা দাগের মধ্যে, যেমন-/ক/ এবং সহধ্বনি ও ধ্বনিকে তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে, যেমন- [স] লিখব। দুটো শব্দ দিয়ে বোঝানো যাক- ‘লংকা’ ও ‘উলটো’। শব্দ দুটি কানে শুনে মুখে উচ্চারণ করো। এবার মন দিয়ে দ্যাখো দুটো শব্দের ‘ল্’ উচ্চারণ করার সময়ে জিভের আগাটা ওপরে তালুতে ঠিক কোনখানে ঠেকছে। এক জায়গায় নয়, তাই তো? লংকা-র ল-এ জিভ ওপরের পাটির সামনের দাঁতের পিছনের মাড়ির পিছনে বা দন্তমূলে ঠেকছে; আর উলটো-র ল আরো একটু পিছনে, যেখানে ট্ উচ্চারণ হচ্ছে সেখানেই ল্-ও উচ্চারণ হচ্ছে। অতএব বাংলায় ল্-এর দু-রকম উচ্চারণ ভেদ পাওয়া যাচ্ছে। এবার উচ্চারণ করো ‘আলতা’। এই ল্-তে জিভ কোথায় ঠেকছে? সামনের পাটির দাঁতের পিছনে, যেখানে ত্ উচ্চারণ হচ্ছে ঠিক সেখানে। অর্থাৎ ল্-এর উচ্চারণের তৃতীয় বৈচিত্র্য পাওয়া যাচ্ছে। বাংলা ল্-এর এই তিন রকম উচ্চারণভেদকে ধ্বনিতত্ত্বের ভাষায়নীচের মতো করে প্রকাশ করা হয়।
অর্থাৎ প্রতিবেশ বিশেষে বাংলা/ল্/-এর তিন রকম উচ্চারণ হয়।/ল/-কে বলে ধ্বনিমূল এবং এর তিন রকম উচ্চারণভেদকে বলে সহধ্বনি। /ল্/ বলার সময়ে বাস্তবে আমরা উচ্চারণ করি/ল/-এর তিনটি সহধ্বনির যে-কোনো একটি। তবে যেটিই উচ্চারণ করি না কেন আমরা জানি যে আমাদের টার্গেট বা লক্ষ্য হল মূলধ্বনি/ল/। সহধ্বনির উচ্চারণ প্রতিবেশ নির্ভর। প্রতিবেশ-নির্ভর বলতে বোঝায় উচ্চারণ প্রবাহে আগের বা পরের কোনো ধ্বনির প্রভাবে কোনো ধ্বনিমূলের একটি নির্দিষ্ট সহধ্বনির উচ্চারিত হওয়া। যেমন- ঠিক পরেই মূর্ধণ্যধ্বনি থাকায় তার প্রভাবে মূর্ধণ্য [ল] সহধ্বনিটি উচ্চারণ হয় বা ঠিক পরেই দন্ত্যধ্বনি থাকলে দন্ত্য [→] উচ্চারণ হয়। এ ছাড়া অন্যান্য প্রতিবেশে দন্তমূলীয় [ল] উচ্চারণ হয়। নির্দিষ্ট প্রতিবেশে নির্দিষ্ট সহধ্বনিটিই উচ্চারিত হয়, অন্য কোনোটি নয়। অর্থাৎ মূর্ধণ্য [ল] দিয়ে আলতা, বা দন্ত্য দিয়ে উলটো, বা এ দুটির কোনো একটি দিয়ে লংকা উচ্চারণ করা যাবেই না। সহধ্বনির এই অপরিবর্তনীয় প্রতিবেশে অবস্থানকে বলা হয় পরিপূরক অবস্থান।
ধ্বনিমূল না সহধ্বনিঃ
ধ্বনিতত্ত্বের অন্যতম দায়িত্ব হল ভাষায় উচ্চারিত বিভিন্ন ধ্বনির মধ্যে ধ্বনিমূল ও সহধ্বনি শনাক্ত করা। সূক্ষ্মভাবে বলতে হয় কোন্ ধ্বনিটি কোন্ ধ্বনিমূল পরিবারের সহধ্বনি তা শনাক্ত করা। এই কাজের কয়েকটি পদ্ধতি আছে। এখানে খুব সংক্ষেপে তিনটি উল্লেখ করা হল।
(ক) ন্যূনতম শব্দজোড় : ওপরে উল্লেখ করা ‘জাল’ ও ‘জাম’-এর মতো শব্দজোড়কে, যেখানে দুটি ভিন্ন শব্দের মধ্যে উচ্চারণের ন্যূনতম পার্থক্য বর্তমান, ন্যূনতম শব্দজোড় বলা হয়। ন্যূনতম শব্দজোড়ের পৃথক ধ্বনি দুটিকে ভাষায় দুটি পৃথক ধ্বনিমূল বলে শনাক্ত করা হয়। অর্থাৎ ন্যূনতম শব্দজোড়ে উচ্চারিত দুটি ধ্বনি ভাষার দুটি পৃথক ধ্বনিমূল। যেমন-তালা-থালা, নরম-গরম, দশক-দমক, দরগা-দরজা, ঝুল-ঝোল, তিল-তেল, ভালো-কালো, দাম-দান।
(খ) পরিপূরক অবস্থান- উচ্চারণগতভাবে মিল আছে এমন যে ধ্বনিগুলি নিজেদের নির্দিষ্ট প্রতিবেশে উচ্চারিত হয়, অর্থাৎ একটির জায়গায় অন্যটি উচ্চারিত হয় না, অর্থাৎ পরিপূরক অবস্থানে থাকে, সেই ধ্বনিগুলি কোনো একটি ধ্বনিমূলের সহধ্বনি হিসেবে শনাক্ত হয়। যেমন ওপরে উল্লিখিত তিন ধরনের/ল্/।
(গ) কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় দুটি ধ্বনি পার্থক্যমূলক অবস্থানে রয়েছে, আপাতবিচারে ন্যূনতম শব্দজোড়ের মতো, কিন্তু জোড়ের শব্দ দুটির মধ্যে অর্থের কোনো পার্থক্য নেই। যেমন, ‘গাঢ়’ শব্দটা কারো উচ্চারণে গাঢ়, আবার কারো উচ্চারণে গাড়। এই তফাতের ওপর প্রতিবেশের কোনো প্রভাব নেই। বরং এটি অভ্যাস বা সামর্থ্য অনুযায়ী যেমন খুশি উচ্চারণ। এই রকম উচ্চারণভেদকে বলে ধ্বনির মুক্ত বৈচিত্র্য। এই মুক্ত বৈচিত্র্যের ধ্বনিগুলিও ভাষায় সহধ্বনি বলে গণ্য। বাংলায় [ঢ়]
-কে ঘিরে বিতর্কটা হল এটি কারো উচ্চারণে ধ্বনিমূল, আবার কারো উচ্চারণে [ড়]-এর সহধ্বনি।
ধ্বনিমূলের অবস্থান ও সমাবেশ
ধ্বনিতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে পড়ে ধ্বনিমূলের অবস্থান ও সমাবেশ। অবস্থান বলতে বোঝায় একটি ধ্বনিমূল শব্দে কোন্ কোন্ অংশে ও কোন্ কোন্ ধ্বনি প্রতিবেশে উচ্চারিত হতে পারে তার খবর। আর সমাবেশ বলতে বোঝায় একটি ধ্বনিমূল আর কোনো কোনো ধ্বনিমূলের সঙ্গে একত্রিত হয়ে যুক্তধ্বনি তৈরি করতে পারে তার খবর।
ধ্বনিমূলের অবস্থান:
শব্দের নানা অংশ। শব্দ শুরুর মুখটা হল আদ্য, শব্দের একেবারে শেষ অংশটা হল অন্ত্য, বাকি অংশটুকু মধ্য, দুটি স্বরধ্বনির মধ্যবর্তী অংশ হল স্বরমধ্যগত প্রতিবেশ ইত্যাদি। এ ছাড়াও আছে নির্দিষ্ট ধ্বনির প্রতিবেশ, অর্থাৎ আলোচ্য ধ্বনিমূলটির ঠিক পূর্ববর্তী বা ঠিক পরবর্তী ধ্বনিটি কী? অন্যভাবে বলা যায়, আলোচ্য ধ্বনিমূলটি কোন্ কোন্ ধ্বনির পরে বা কোন্ কোন্ ধ্বনির আগে উচ্চারিত হতে পারে।
ধ্বনির সমাবেশ: ধ্বনির সমাবেশ:
বিভিন্ন ধ্বনির সমাবেশের ফলে বিভিন্ন ধরনের যুগ্মধ্বনি তৈরি হয়। স্বরধ্বনির সঙ্গে অর্ধস্বরের সমাবেশে তৈরি হয় দ্বিস্বরধ্বনি। অর্ধস্বরের জন্যে কোনো বর্ণ নির্দিষ্ট নেই। তাই উচ্চ ও উচ্চমধ্য চারটি অর্ধস্বরকে বোঝাবার জন্যে এগুলির পালটি স্বরধ্বনিতে হসন্ত চিহ্ন তৈরি করে নেওয়া হল। স্বরধ্বনির সঙ্গে এই চারটি অর্ধস্বরের সমাবেশে বিভিন্ন দ্বিস্বরধ্বনি তৈরি হয়। এইরকম চারটি দ্বিস্বরধ্বনি হল [ওউ], [ওই], [অএ], [অও] যেমন উচ্চারিত হয় যথাক্রমে মৌ, কই, হয় ও হও শব্দে।
ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে ব্যঞ্জনধ্বনি সমাবেশে দু-ধরনের যুগ্মধ্বনি তৈরি হয়- গুচ্ছধ্বনি ও যুক্তধ্বনি। বাংলায় যে-কোনো ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে যে-কোনো ব্যঞ্জনধ্বনির সমাবেশ ঘটে না। এক্ষেত্রে যথেষ্ট বিধিনিষেধ দেখা যায়। তবে গুচ্ছধ্বনির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের মাত্রা কম, ফলে সমাবেশের সংখ্যা অনেক বেশি। অপরপক্ষে যুক্তধ্বনির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের মাত্রা অনেক বেশি হওয়ায় সমাবেশের সংখ্যা অনেক কম।
গুচ্ছধ্বনি:
পাশাপাশি উচ্চারিত দুটি ব্যঞ্জনধ্বনির সমাবেশকে গুচ্ছধ্বনি বলে। যাদের মাঝখানে কোনো স্বরধ্বনি নেই। এই দুই ব্যঞ্জনের মাঝে কোনো স্বরধ্বনি না থাকলেও দলসীমা থাকে, অর্থাৎ দুটি ব্যঞ্জনের প্রথমটি পূর্ববর্তী দলের ও শেষেরটি পরবর্তী দলের অংশ বলে গণ্য হয়। গুচ্ছধ্বনির সমাবেশ যুক্তধ্বনির তুলনায় বেশ আলগা কারণ এখানে ধ্বনির গুচ্ছটি ভেঙে দুটি ভিন্ন দলে ভাগ হয়ে যায়। যেমন, উত্তর শব্দটিতে পাশাপাশি দুটি [ত্] উচ্চারিত হয়ে একটি গুচ্ছধ্বনি তৈরি করলেও আসলে দুটি [ত] দুটি পৃথক দল বা সিলেবলের অন্তর্ভুক্ত। সেই রকমই পাওয়া যায় নিশ্বাস, বস্তা, অক্ষয়, শঙ্কা, দেখতে, করছি-এই গুচ্ছধ্বনিগুলি। গুচ্ছধ্বনি শব্দের অভ্যন্তরে থাকে, সীমানায় নয়।
বাংলায় দুটি ব্যঞ্জনধ্বনির সমাবেশে তৈরি গুচ্ছধ্বনির সংখ্যা ২০০টির বেশি।
তিনটি ব্যঞ্জনধ্বনির সমাবেশেও গুচ্ছধ্বনি তৈরি হয়। যেমন- অস্ত্র ও যন্ত্র শব্দে। তিনটি ব্যঞ্জনধ্বনির সমাবেশে তৈরি গুচ্ছধ্বনির তৃতীয় ব্যঞ্জনটি সদাসর্বদাই [র] এবং বাংলায় এরকম গুচ্ছধ্বনির সংখ্যা ৮টি।
চারটি ব্যঞ্জনধ্বনির সমাবেশে তৈরি গুচ্ছধ্বনি বাংলায় মাত্র ১টি ক্ষেত্রে, তা হল ‘সংস্কৃত’ শব্দটি।
যুক্তধ্বনি: যুক্তধ্বনি:
যে ব্যঞ্জনধ্বনির সমাবেশগুলি শব্দের আদ্য অবস্থানে বা দলের আদিতে উচ্চারিত হতে পারে সেগুলিকে যুক্তধ্বনি বলে। যুক্তধ্বনির সমাবেশ গুচ্ছধ্বনির তুলনায় বেশি পাকাপোক্ত কারণ এই ধ্বনিগুলির মাঝে কোনো দলসীমা থাকে না। দুই ব্যঞ্জন সমাবেশের যুক্তধ্বনিতে হয় প্রথম ব্যঞ্জনটি [স্], নয়তো দ্বিতীয় ব্যঞ্জনটি [র] বা [ল] হয়। বাংলা শব্দে এই রকম যুক্তধ্বনির সংখ্যা ২৮টি।
তিন ব্যঞ্জনের সমাবেশে তৈরি যুক্তধ্বনির সংখ্যা ২টি, স্ত্র ও স্পৃ যেমন পাওয়া যায় স্ত্রী, স্পৃহা ইত্যাদি শব্দে।
অবিভাজ্য ধ্বনি :
বিভাজ্য ধ্বনিকে মুখের কথার ধ্বনিপ্রবাহ থেকে কৃত্রিমভাবে হলেও খণ্ড খণ্ড করে বিভাজন করা যায়। যেমন- তুমি কথাটার উচ্চারণের খন্ডগুলি হলো ত্+উ+ম্+ই। কিন্তু ভাষায় আরো কিছু ধ্বনি উপাদান থাকে যেগুলিকে এই রকম কৃত্রিমভাবেও খণ্ড করা যায় না। কারণ এই রকম উপাদানগুলি কোনো বিভাজ্যধ্বনির অংশ নয়, বরং এগুলি একাধিক ধ্বনিখণ্ড জুড়ে অবস্থান করে। এগুলিকে অবিভাজ্য ধ্বনি বলে। বাংলাতেও এই রকম কয়েকটা অবিভাজ্য ধ্বনি আছে।
নীচে কয়েকটি অবিভাজ্য ধ্বনির পরিচয় দেওয়া হল।
শ্বাসাঘাত:
শ্বাসাঘাত হল একাধিক দলযুক্ত শব্দের কোনো একটি দলকে অপেক্ষাকৃত বেশি জোর দিয়ে উচ্চারণ করা। বাংলায় সাধারণত শব্দের প্রথম দলটিতে শ্বাসাঘাতের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। যান্ত্রিক নিরীক্ষাতেও প্রথম দলে শ্বাসাঘাতের উপস্থিতি দেখা যায়। শ্বাসাঘাতের উপস্থিতি পুরো দল জুড়ে, কোনো নির্দিষ্ট ধ্বনিতে নয়। তাই এটি অবিভাজ্য ধ্বনি। যেমন- মাখন, আরতি, লোকবল, শব্দের প্রথম দল মা, আ, লোক, শব-এর ওপর শ্বাসাঘাত পড়ে।
দৈর্ঘ্য:
দৈর্ঘ্য বলতে সাধারণত বোঝায় দলের উচ্চারণে স্বরধ্বনির দৈর্ঘ্য। বাংলায় বহুদল শব্দের স্বরধ্বনির তুলনায় একদল শব্দের স্বরধ্বনির দৈর্ঘ্য বেশি, ফলে একদল শব্দের দৈর্ঘ্যও বেশি। যেমন- ‘আমার’ শব্দের [আ]-এর চেয়ে ‘আম’ শব্দের [আ] বেশি দীর্ঘ।
যতি:
যতি হল দল বা শব্দসীমায় অপেক্ষাকৃত লম্বা ছেদ। যেমন, ‘রহিম একা দশজনকে চ্যালেঞ্জ করেছে’ এবং ‘রহিম একাদশজনকে চ্যালেঞ্জ করেছে’। প্রথম বাক্যে ‘একা’ শব্দ উচ্চারণের পরে আমরা যতি ব্যবহার করি, কিন্তু দ্বিতীয়টিতে ‘একাদশজনকে’ যতি ছাড়াই উচ্চারণ করি।
সুরতরঙ্গ:
বাক্যে সুরের ওঠাপড়াকে সুরতরঙ্গ বলে। যেমন- বিবৃতিবাক্য ‘মিঠু কাল স্কুল যাবে’। এবং প্রশ্নবাক্য ‘মিঠু কাল স্কুলে যাবে?’ এই দুটি বাক্যের উচ্চারণে সুরের ওঠাপড়া দু-রকমের। অর্থাৎ এই দু-ধরনের বাক্যে আমরা নীচের মতো দু-রকমের সুরতরঙ্গ ব্যবহার করি।
বিবৃতিবাক্য – মিঠু কাল স্কুলে যাবে।
প্রশ্নবাক্য – মিঠু কাল স্কুলে যাবে ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর :
১) মুখের মান্য বাংলায় স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি সংখ্যা কত ?
উত্তর – মুখের মান্য বাংলার স্বরধ্বনি ৭ টি এবং ব্যঞ্জনধ্বনি ৩০ টি।
২) মৌলিক স্বরধ্বনি কাকে বলে ?বাংলায় মৌলিক স্বরধ্বনি কয়টি?
উত্তর- যেসব স্বরধ্বনিকে বিশ্লেষণ করা যায় না তাদেরকে মৌলিক স্বরধ্বনি বলে।
বাংলায় মৌলিক স্বরধ্বনির সংখ্যা ৭ টি। যথা – অ, আ, ই, উ, এ, ও, অ্যা
৩) ধ্বনিমূল কাকে বলে ?
উত্তর – বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানে উচ্চারণ বৈচিত্রসহ প্রত্যেকটি মূলধ্বনিকে ধ্বনিমূল বলে।
৪) সহধ্বনি কাকে বলে ?
উত্তর – কোনো নির্দিষ্ট ধ্বনির উচ্চারণ স্থান তার অবস্থান অনুযায়ী বদলে যায় । প্রতিবেশ অনুযায়ী ধ্বনির উচ্চারণভেদকে সহধ্বনি বলে।
৫) ন্যূনতম শব্দজোড় বলতে কী বোঝ? উদাহরণ দাও।
উত্তর – দুটি ভিন্ন শব্দের মধ্যে উচ্চারণগত ন্যূনতম (একটি মাত্র) পার্থক্য থাকলে, সেই শব্দজোড়কে বলা হয় ন্যূনতম শব্দজোড়। যেমন :- ‘আম’ ও ‘জাম’।
৬) গুচ্ছধ্বনি কাকে বলে ?
উত্তর – পাশাপাশি উচ্চারিত দুটি ব্যঞ্জনধ্বনির সমাবেশকে গুচ্ছধ্বনি বলে । যেমন উত্তর , এখানে পাশাপাশি দুটি [ত্] উচ্চারিত হয়ে একটি গুচ্ছধ্বনি তৈরি করেছে।
৭) বাংলা ভাষায় দুই ব্যঞ্জনে এবং তিন ব্যঞ্জনে তৈরি গুচ্ছধ্বনির সংখ্যা কয়টি?
উত্তর – বাংলা ভাষায় দুই ব্যঞ্জনে তৈরি গুচ্ছধ্বনির সংখ্যা ২০০ এর বেশি এবং তিন ব্যঞ্জনের সমাবেশে ৮টি।
৮) বাংলা ভাষায় চার ব্যঞ্জনের গুচ্ছধ্বনি দিয়ে তৈরি একটি শব্দের উদাহরণ দাও?
উত্তর — বাংলা ভাষায় চার ব্যঞ্জনের গুচ্ছধ্বনি দিয়ে তৈরি একটি শব্দ হল – ‘সংস্কৃত’।
৯) যুক্ত ধ্বনি কাকে বলে ?
উত্তর – যে ব্যঞ্জনধ্বনির সমাবেশগুলি শব্দ বা দলের আদিতে উচ্চারিত হয় সেগুলিকে যুক্তধ্বনি বলে। যেমন – প্রথম, তৃতীয়, স্কুল ইত্যাদি।
১০) অবিভাজ্য ধ্বনি কাকে বলে ?
উত্তর – যে ধ্বনি উপাদানগুলিকে কৃত্রিমভাবে খন্ড করা যায়না সেগুলিকে অবিভাজ্য ধ্বনি বলে । কয়েকটি অবিভাজ্য ধ্বনি হলো – শ্বাসাঘাত, দৈর্ঘ্য ,যতি,সুরতরঙ্গ।
১১) শ্বাসাঘাত কী ? উদাহরণ দাও।
উত্তর – শ্বাসাঘাত হল একাধিক দলযুক্ত শব্দের কোনো একটি দলকে অপেক্ষাকৃত বেশি জোর দিয়ে উচ্চারণ করা। শ্বাসাঘাতের উপস্থিতি পুরো দল জুড়ে, কোনো নির্দিষ্ট ধ্বনিতে নয়। বাংলায় সাধারণত শব্দের প্রথম দলে শ্বাসাঘাতের উপস্থিতি দেখা যায়।
যেমন :- শব্দ (শব্+দ) ; এখানে শব্ -এই শব্দটিতে শ্বাসাঘাত পড়েছে।
১২) দৈর্ঘ্য কী ? উদাহরণ দাও।
উত্তর – দৈর্ঘ্য বলতে সাধারণত বোঝায়া দলের উচ্চারণে স্বরধ্বনির দৈর্ঘ্য। বাংলায় বহুদল শব্দের স্বরধ্বনির তুলনায় একদল শব্দের স্বরধ্বনির দৈর্ঘ্য বেশি। যেমন :- ‘আমার’ শব্দের ‘আ’ অপেক্ষা ‘আম’ শব্দের ‘আ’-এর দৈর্ঘ্য বেশি।
১৩) যতি কাকে বলে?
উত্তর – আমাদের বাকপ্রবাহের ধারায় দুটি স্বনিমের মধ্যবর্তী বিরতিকে বা শব্দসীমায় অপেক্ষাকৃত লম্বা ছেদকে, বলা হয় যতি।
১৪) সুর তরঙ্গ কাকে বলে ?
উত্তর- বাক্যে সুরের ওঠাপড়াকে সুরতরঙ্গ বলে । যেমন বিবৃতিবাক্য- ‘মিঠু কাল স্কুল যাবে’ এবং প্রশ্নবাক্য ‘মিঠু কাল স্কুল যাবে ?’ – এই দুটি বাক্যের উচ্চারণে সুরের ওঠাপড়া দু’রকমের।