বাংলা সহায়ক

চণ্ডীদাস|পদাবলির চণ্ডীদাস|chandidas|padabalir chandidas


দাবলীর চণ্ডীদাস (১৩৭০-১৪৩০) :

বিদ্যাপতির সমসাময়িক একজন শ্রেষ্ঠ  কবি চণ্ডীদাস। চৈতন্যপূর্বযুগে বিদ্যাপতির সমসাময়িক  একজন শ্রেষ্ঠ রাধাকৃষ্ণ-পদাবলি রচয়িতা কবি চণ্ডীদাস । যিনি বাংলা ভাষায় প্রথম পদাবলি সাহিত্য রচনা করেন । এবং চণ্ডীদাস জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন । চণ্ডীদাসকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে কারন - চণ্ডীদাস নামধারী অন্তত চারজন কবি ছিলেন বলে সাহিত্যের ঐতিহাসিকগণ সমস্যায় পড়েছেন যার প্রকৃত সমাধান এখনও হয়নি ।


🔵 চণ্ডীদাস প্রাক-চৈতন্যযুগের কবি (পঞ্চদশ শতাব্দী)

🔵 বীরভূম জেলার অন্তর্গত নান্নুর গ্রামে (সম্ভবত ১৪১৭ খ্রিস্টাব্দে) তাঁর জন্ম হয়।

🔵 তিনি বাশুলি বা চণ্ডীর উপাসক ছিলেন। 

🔵 চণ্ডীদাস ‘রামী' নামে এক রজক কন্যাকে সাধনসঙ্গিনীরূপে গ্রহণ করেন।

🔵 পূর্বরাগ পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি চণ্ডীদাস।

🔵 চণ্ডীদাস সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ  ঠাকুর মন্তব্য করেছিলেন - 'চণ্ডীদাস সহজ ভাষায় সহজ ভাবের কবি—এই গুণে তিনি বঙ্গীয় প্রাচীন কবিদের মধ্যে প্রধান কবি'। তাঁর মতে  চণ্ডীদাস 'দুঃখের কবি'।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়-- চণ্ডীদাস একছত্র লিখে পাঠককে দশছত্র লিখিয়ে নেন।


🔵 বঙ্কিমচন্দ্র চণ্ডীদাস সম্পর্কে বলেছিলেন - 'সায়াহ্ন সমীরণের দীর্ঘশ্বাস'।

🔵 মহাপ্রভু যে  চণ্ডীদাসের পদ আস্বাদন করতেন তার প্রমাণ পাই কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত  'চৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থে । সেখানে বলা হয়েছে—

 “চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি রায়ের নাটকগীতি

 কর্ণামৃত শ্রীগীতগোবিন্দ ।

স্বরূপ রামানন্দ সনে মহাপ্রভু রাত্রিদিনে

গায় শুনে পরমানন্দ ।।"

🔵 চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য হলেন জ্ঞানদাস।

🔵 চণ্ডীদাস সম্পর্কে সর্বপ্রথম বিস্তৃত আলোচনা করেন -- রামগতি ন্যায়রত্ন।


🔵 চণ্ডীদাসের সঙ্গে বিদ্যাপতির পার্থক্য :

চণ্ডীদাস গ্রামবাংলার কবি। পাণ্ডিত্যবর্জিত সহজসরল ভাষায় তিনি রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক পদ রচনা করেন। অন্যদিকে বিদ্যাপতি নাগরিক কবি পণ্ডিত। তাই তাঁর রচনায় বাকবৈদগ্ধ ও মণ্ডলকলার বৈচিত্র্য আছে।

 রবীন্দ্রনাথের মতে : 

(ক) বিদ্যাপতি সুখের কবি, চণ্ডীদাস দুঃখের কবি’ । 

(খ)  চণ্ডীদাস গভীর এবং ব্যাকুল, বিদ্যাপতি নবীন এবং মধুর।


চণ্ডীদাসের রচনারীতির বৈশিষ্ট্য :

চণ্ডীদাস একান্ত সহজ সরল গ্রাম্য জনগণের প্রচলিত আটপৌরে ভাষায় তিনি পদাবলি রচনা করেছেন। সাধারণ বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ভাষাতেই তার পদ রচনা । কিন্তু সেই সর্বজনপরিচিত লৌকিক ভাষা চণ্ডীদাসের সহজাত প্রতিভার স্পর্শে অলৌকিক ভাবব্যঞ্জনায় শিল্পমূল্য পেয়েছে। তাঁর ভাষা শব্দের বন্ধন ছাড়িয়ে ভাবের স্বাধীন লোকে ঊর্ধ্বগামী হয়েছে। ভাষার অলংকরণে সচেতনভাবে প্রয়াসী না হলেও কল্পনায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে আবেগে যা সৃষ্টি করেছেন তা গভীর ভাবব্যঞ্জনায় শ্রেষ্ঠ শিল্পরূপ লাভ করেছে।


 

পূর্বাগের শ্রেষ্ঠ কবি কে ? তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের কারণ কী ?


চণ্ডীদাস পূর্বরাগের শ্রেষ্ঠ কবি। তার পূর্বরাগের পদগুলিতে শ্রীরাধার হৃদয়গ্রাহী ব্যাকুলতা যে বেদনাঘন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে সমগ্র বৈষ্ণব পদসাহিত্যে তার তুলনা নেই। মানবহৃদয়ের চিরন্তন প্রেমাকূলতা যেন এসকল পদে রূপ লাভ করেছে। মানবিক আবেদনে সর্বজনস্বীকৃত একটি পূর্বরাগের পদ—

“সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম।

কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো

আকুল করিল মোর প্রাণ।”


চণ্ডীদাসের কাব্য মানবতা, মর্ত্যপ্রীতি ও বাস্তবতার ত্রিবেণী সঙ্গম। রাধাকৃষ্ণের প্রেমকথা বলতে গিয়ে তার পক্ষে এই মানবতা থেকে বিস্মৃত হওয়া সম্ভব হয়নি। পল্লিকবি আসলে সহজিয়া দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছিলেন—‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। মানবজীবন ধন্য, কেননা মানবের সাধনা নির্মল নয়ন, রাধাকৃষ্ণের অপ্রাকৃত প্রেমলীলা দেখতে পারে। কবির চেতনায় ও উপলদ্ধিতে আধুনিকতার সুর ধ্বনিত। জগৎ ও জীবনের লীলাই হল তার দর্শন ।



চণ্ডীদাসের কবি প্রতিভা :

চণ্ডীদাসের কবিপ্রতিভার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য তাঁর গীতিপ্রাণতা। তিনি যেন সৃষ্ট রাধার মধ্যে আপনাকে মিশিয়ে ফেলেছেন। রাধার বিরহ ক্রন্দনে যেন চণ্ডীদাসের ব্যক্তি অনুভূতি আর্ত। চণ্ডীদাসের কবিতায় ভাবাবেগের প্রাধান্য লক্ষিত। রাধার প্রেমানুভূতিতে এক ইন্দ্রিয়ে অনির্বচনীয় আত্মহারা ভাব আছে। নিখিলের রূপ থেকে অরূপের দিকে চিরন্তন সৌন্দর্য ও প্রেমকামনার এবং বিরহের সুতীব্র আর্তি চণ্ডীদাসের কবিতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ।


চণ্ডীদাস-সমস্যা :
বাংলা ভাষায় রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম সম্পর্কিত প্রায় ১২৫০ টির অধিক পদের সন্ধান পাওয়া গেছে যেখানে রচয়িতা হিসেবে বড়ু চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস ও দ্বিজ চণ্ডীদাস তিনটি ভিন্ন নামের উল্লেখ রয়েছে আবার কোনোটিতে রচয়িতার নামের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় নি। এ কাব্যগুলো ভণিতা নামে পরিচিত। ভণিতা একই ব্যক্তি কর্তৃক রচিত কিনা তা পরিষ্কার করে জানা যায় না। আধুনিক পণ্ডিতরা ধারনা করে থাকেন, বর্তমান যে সকল কবিতা চণ্ডীদাসের নামে রয়েছে তা অন্তত চারজন ভিন্ন চণ্ডীদাস কর্তৃক রচিত হয়েছে। ভণিতা কাব্যের রচনাশৈলী অনুযায়ী তাদের পৃথক করা যায়।

প্রথম চণ্ডীদাস হিসেবে পদাবলীর চণ্ডীদাসকে ধারণা করা হয় যিনি আনুমানিক ১৪ শতকে বীরভূম জেলায় (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ) জন্ম নেন; তিনি চৈতন্য-পূর্ব বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলী রচয়িতা হিসেবে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। কারও কারও মতে, তিনিই মধ্যযুগীয় বাংলা কবিতার অন্যতম নিদর্শন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচনা করেন। তবে ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যা ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচয়িতা বড়ুচণ্ডীদাস বাঁকুড়া জেলার সদর মহকুমাস্থ ছাতনার অধিবাসী ছিলেন। এই কাব্যে কবি নিজেকে অনন্ত বড়ু চন্ডীদাস হিসাবে ভণিতা দিয়েছেন। তাঁর আসল নাম অনন্ত, কৌলিক উপাধি বড়ু, এবং গুরুপ্রদত্ত নাম চণ্ডীদাস। তিনি বাসলী/বাশুলী দেবীর উপাসক ছিলেন (বীরভূমের নানুরে এই দেবীর মন্দির আছে)। "বড়ু" শব্দটি "বটু" বা "বাড়ুজ্যে" (বন্দ্যোপাধ্যায়) শব্দের অপভ্রংশ বলে মনে করা হয়।

চণ্ডীদাসের মৃত্যু সম্বন্ধে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কর্তা বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ স্থানীয় প্রবাদের উল্লেখ করেছেন — বীরভূমের নানুরে বাশুলীদেবীর মন্দিরের কাছে চণ্ডীদাসের কীর্তন দলের একটি নাট্যশালা ছিল। চণ্ডীদাস একবার গৌড়ের নবাবের রাজসভায় গান গাওয়ার অনুরোধ রক্ষা করতে সেখানে যান। তাঁর কণ্ঠে ভক্তি-প্রেমের গান শুনে নবাবের বেগম মুগ্ধ হয়ে যান এবং তিনি চণ্ডীদাসের গুণের অনুরাগিণী হয়ে পড়েন। বেগম একথা নবাবের কাছে স্বীকার করলে নবাব ক্রোধের বশে চণ্ডীদাসকে মৃত্যুর দণ্ডাদেশ দেন। আত্মীয় বন্ধুবর্গের সামনে চণ্ডীদাস হস্তিপৃষ্ঠে আবদ্ধ হয়ে নিদারুণ কশাঘাত সহ্য করে প্রাণবিসর্জন দেন; বেগম সেই দৃশ্য দেখে শোকে মুর্চ্ছিতা হয়ে প্রাণবিয়োগ করেন। কথিত আছে, শূদ্র কন্যা রামীর সঙ্গে তার প্রেম ছিল বলে স্থানীয় লোকজন তাকে মেরে তার বাড়িতে চাপা দিয়ে দেয়। আবার কারও মতে তিনি সেই সময়ের বৈষ্ণব পীঠস্থান ইলামবাজারে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

দীন চণ্ডীদাস এবং দ্বিজ চণ্ডীদাস নামক ভণিতার দুইজন কবিকে চৈতন্য-পরবর্তী যুগের কবি বলে ধারণা করা হয়। তবে এই নামদুটি ভনিতার হেরফের মাত্র বলেই অনুমিত হয়।

চণ্ডীদাসের কিছু পদ ও তার পর্যায়

(১) সই কেবা শুনাইল শ্যামনাম (পূর্বরাগ)
(২) রাধার কি হইল অন্তরে ব্যথা (পূর্বরাগ)
(৩) ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার (পূর্বরাগ)
(৪) একে কুলবতী ধনি। (পূর্বরাগ)
(৫) এমন পীড়িতি কভূ নাহি দেখি শুনি (পূর্বরাগ)
(৬) কাহারে কহিব মনের মরম (পূর্বরাগ)
(৭) এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা (অভিসার)
(৮) যত নিবারিয়ে চাই নিবার না যায় গো (আক্ষেপানুরাগ)
(৯) বঁধু, কি আর বলিব তোরে (আক্ষেপানুরাগ)
(১০) কি মোহিনী জান বঁধু (আক্ষেপানুরাগ)
(১১) তোমারে বুঝাই বঁধু তোমারে বুঝাই (আক্ষেপানুরাগ)
(১২) মন মোর আর নাহি লাগে গৃহ কাজে (আক্ষেপানুরাগ)
(১৩) কাল জল ঢালিতে সই কালা পড়ে মনে (আক্ষেপানুরাগ)
(১৪) বঁধু কি আর বলিব আমি (নিবেদন)
(১৫) বঁধু তুমি যে অ্যাম্বার প্রাণ (নিবেদন)
(১৬) ললিতার কথা শুনি হাসি হাসি বিনোদিনী (মাথুর)
(১৭) রাইয়ের দশা সখীর মুখে (মাথুর)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ