বাংলা সহায়ক

ভাষা ও চিন্তন |Language and Thought| Child Development and Pedagogy

 

ভাষা ও চিন্তন

Language and Thought

মানুষের কণ্ঠনিঃসৃত বাক্ সংকেতের সংগঠনকে ভাষা বলা হয়। অর্থাৎ বাগযন্ত্রের দ্বারা সৃষ্ট অর্থবোধক ধ্বনির সংকেতের সাহায্যে মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যমই হল ভাষা। 

ভাষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন: ‘মনের ভাব-প্রকাশের জন্য, বাগ-যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনি দ্বারা নিষ্পন্ন, কোনো বিশেষ জনসমাজে ব্যবহৃত, স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত, তথা বাক্যে প্রযুক্ত, শব্দসমষ্টিকে ভাষা বলে।’
অর্থাৎ, নির্দিষ্ট জনসমাজের মানুষ মনের ভাব প্রকাশের জন্য মুখ দিয়ে অন্যের বোধগম্য অর্থপূর্ণ যে ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি উচ্চারণ করে, তাকে ভাষা বলে।

শিশু কোন ভাষা শিখে জন্মায় না। জন্মের পর শিশুর ভাষার বিকাশ শুরু হয়। ব্যক্তির চিন্তা- অনুভূতির আদান-প্রদানের অন্যতম মাধ্যম হল ভাষা। শিশুর ভাষা বিকাশের প্রথম অভিব্যক্তি হল কান্না। প্রায় দশ মাস বয়সে শিশু একটি শব্দ ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। এক বছর বয়সে শিশু তিন থেকে চারটি শব্দ ব্যবহার করতে পারে। বিভিন্ন পরীক্ষা থেকে জানা যায় দুই বছর বয়স থেকেই শিশুর ভাষার বিকাশ দ্রুত হয়। শিশু নতুন নতুন শব্দ আয়ত্ত করতে পারে। ১০ বছর বয়সে শিশু প্রায় ৩৪ হাজারের মতো শব্দ ব্যবহার করতে পারে।


ভাষার উপাদান :
ক) ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology)
খ) বাক্যতত্ত্ব (Syntax)
গ) শব্দার্থতত্ত্ব (Semantics)
ঘ) প্রয়োগ (Pragmatics)

ভাষার ক্ষুদ্রতম একক হল ধ্বনি।
ভাষার অর্থপূর্ণ ক্ষুদ্রতম একক হল রূপিম (Morpheme)
বাক্যবিন্যাস হল ব্যাকরণ।শব্দ বিন্যস্ত হয়ে বাক্যে পরিণত হয়।
অর্থবোধক বর্ণসমষ্টি হল শব্দ। শব্দের অর্থ সম্পর্কে  আলোচনা হল শব্দার্থতত্ত্ব বা শব্দার্থবিধি।
পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী উপযুক্ত শব্দচয়ন ও স্বরক্ষেপণের কৌশল আয়ত্ত করাই হল প্রয়োগ।


চিন্তন
যেসব মানসিক প্রক্রিয়া আমাদের জ্ঞান আহরণে বিশেষভাবে সাহায্য করে বা আমাদের শিখনে সহায়তা করে তাদের মধ্যে চিন্তন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই আধুনিক শিক্ষা মনোবিদ্যায় চিন্তন এক গুরুত্বপূর্ণ  স্থান অধিকার করে আছে। দার্শনিকগণ মনে করেন চিন্তন মনের অস্তিত্বের পরিচায়ক। দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন চিন্তন প্রক্রিয়া মানুষকে অন্যান্য ইতর প্রাণী থেকে পৃথক করে রেখেছে। চিন্তনের প্রকৃত কাজ হল ইন্দ্রিয়জাত অভিজ্ঞতার ক্ষুদ্র গণ্ডিকে অতিক্রম করে, ইন্দ্রিয়াতীতলোকে জ্ঞানের ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করা।

দার্শনিক লক চিন্তনকে এক বিশেষ ধরনের প্রত্যক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করেছেন।তিনি বলেছেন - " Thought is the perception of the agreement and disagreement of ideas." অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের ধারণার মধ্যে মিল ও অমিল প্রত্যক্ষ করার প্রক্রিয়াই হল চিন্তন।

যে প্রক্রিয়ার দ্বারা বিশেষ থেকে সাধারণ ধারণায় আসা যায়, যুক্তির দ্বারা কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায়, সম্বন্ধের আবিষ্কার ও সমস্যার সমাধান করা যায়, তাকে চিন্তন বলে।


চিন্তনের সংজ্ঞা :
সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণের সাহায্যে বস্তু,ব্যক্তি বা অভিজ্ঞতা সম্পর্কে উদ্দেশ্যমুখী সামগ্রিক বিমূর্তজ্ঞান আহরণের প্রতিক্রিয়াই হল চিন্তন।

চিন্তনকে দুইভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়।
ক) মানসিক প্রতিরূপ (Mental Image)
    ---- কাল্পনিক চিত্রের মতো।

খ) বিমূর্ত মানসিক কাঠামো (Abstract Mental Structure )
  ---- সাংকেতিক  চিহ্নের মতো।


চিন্তনের বৈশিষ্ট্য :


১। নির্বাচনধর্মী ক্রিয়া --- নীতি প্রয়োগ করে সমস্যার সমাধান।

২। বিশ্লেষণী ক্ষমতা চিন্তনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য।

৩। মনের সক্রিয়তা চিন্তনের আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য।

৪। চিন্তন সৃজনধর্মী ক্রিয়া। সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে চিন্তনের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

৫। চিন্তন শিশুর ভাষা বিকাশে সাহায্য করে।

৬। বিমূর্ত ধারণাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে।


ভাষা ও চিন্তন :


মানুষের জীবনে ভাষা আর চিন্তন প্রায় সমকালীন।ভাষা বস্তু ও ভাব উভয়ের প্রতীক; ভাষা বিমূর্ত এবং প্রতীকধর্মী। চিন্তনও ভাবনির্ভর এবং প্রতীকধর্মী। তাই ভাষা ও চিন্তনের মধ্যে সম্পর্ক নিবিড়।ধ্বনি আর রূপের মধ্যে দিয়ে চিন্তন আকারপ্রাপ্ত হয়। তাই ভাষা চিন্তার বাহনও বটে, আবার বহিঃপ্রকাশও বটে।

মনোবিদ পিয়াজেঁ মনে করেন প্রথমে চিন্তন বা ভাবনা এসেছে, তারপর ভাষা। শিশু আশেপাশের জিনিসগুলো দেখার পর তার মনে আগে থেকেই Thought থাকে, তারপর সে কথা বলতে শুরু করে। পিয়াজেঁ বলেছেন শিশুর বিকাশের উপর ভাষার প্রভাব নেই, বিকাশ থেকে ভাষা আসে। তাঁর মতে Development থেকে Learning হয়।

ভাইগটস্কি মনে করেন প্রথমে ভাষা তারপর চিন্তন। অর্থাৎ Learning থেকে Development.

নোয়াম চমস্কির মতে মানব মস্তিষ্কে প্রি-প্রোগ্রামড অবস্থায় আছে এমন এক ব্যাকরণ যাকে সর্বজনীন ব্যাকরণ বলে। অর্থাৎ তিনি ভাষার সর্বজনীনতার কথা বলেছেন। চমস্কি বলেন মানব শিশুই ভাষা শেখার জন্মগত ক্ষমতার অধিকারী।

তাঁর মতে, মানুষের মস্তিষ্কে লাঙ্গুয়েজ অ্যাকুইজিশন ডিভাইস থাকে,যা মানুষের ভাষা বলার সহজাত ক্ষমতাকে উসকে দেয়, সেটাই সংক্ষেপে ল্যাড (LAD)
পরে তিনি এটাকে ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকুইজিশন সিস্টেম (LAS) বলেছেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ