বাংলা ছাত্রছাত্রীদের পাশে সারাক্ষণ

ধ্বনিতত্ত্ব |Dhonitatto |বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি |ভাষা |Bhasa|উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা |তৃতীয় সেমেস্টার

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি

উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা  

তৃতীয় সেমেস্টার

ধ্বনিতত্ত্ব

ভূমিকা :

সাধারণভাবে বলা যায় যে, ভাষাবিজ্ঞানের যে অংশে ধ্বনি সম্পর্কে আলোচনা হয়, তাকেই ধ্বনিতত্ত্ব বলে। মানুষের বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনিই শুধু আলোচ্য। হাসি, কান্না, হাঁচি, নাকডাকা, ভয়ের চিৎকার অথবা বৃষ্টির শব্দ, ঝড়ের আওয়াজ, গাড়ির হর্ণ, কুকুরের ডাক ইত্যাদি sound বা শব্দ হলেও  কিন্তু ধ্বনি বলে গণ্য নয়। 

ধ্বনিতত্ত্ব কিন্তু বর্ণ বা লেখার ব্যাপার নিয়ে একটুও মাথা ঘামায় না। ধ্বনিতত্ত্বের আলোচ্য বাধ্বনি, অর্থাৎ মুখের ভাষা বা মুখের কথা। ধ্বনি, শব্দ বা পদ ইত্যাদি হল ভাষা শরীরের এক-একটি স্তর। সবচেয়ে নীচে ধ্বনিস্তর, তার ওপরে রূপস্তর, তার ওপরে পদ, তার ওপরে বাক্যস্তর, আরও আছে অর্থের স্তর। ভাষার ধ্বনিস্তর নিয়ে আলোচনার নাম ধ্বনিতত্ত্ব। এখানে বাগধ্বনি সম্বন্ধে তিনটে জরুরি কথা মনে রাখা দরকার।

(১) আমরা মনে রাখব যে যদিও ধ্বনিখণ্ডের চেয়ে ধ্বনিপ্রবাহের বাস্তবতা অনেক বেশি তবুও বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে ব্যাকরণের গন্ডিতে আমরা খণ্ডধ্বনিকেই গুরুত্ব দেবো। খণ্ডধ্বনির নাম বিভাজ্যধ্বনি।

(২) ধ্বনিতত্ত্বের আলোচ্য একক বাগধ্বনি হল ভাষার অর্থহীন এবং ক্ষুদ্রতম একক। আবার এও মনে রাখতে হবে অর্থহীন হলেও ভাষার মানে তৈরির এলাকায় এর ভূমিকা অপরিসীম।

(৩) আমরা ধ্বনি উচ্চারণ করে মুখে যা বলি তা বাংলা লিপির বর্ণ ব্যবহার করে লিখেও ফেলি। কিন্তু এই ধ্বনি ও বর্ণের পারস্পরিক সম্পর্কটা খুব সরল নয়। 

ধ্বনিতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়:

১) মুখের মান্য বাংলায় স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি সংখ্যা কত ?

ধ্বনিতত্ত্বের আলোচ্য বিষয় হল একটি নির্দিষ্ট ভাষার বাগধ্বনির ব্যবহারিক চরিত্র। ভাষাবিজ্ঞানের দুটি শাখায় বাগধ্বনি নিয়ে আলোচনা করা হয়- ধ্বনিবিজ্ঞান ও ধ্বনিতত্ত্ব। ধ্বনিবিজ্ঞান বাগধ্বনির উচ্চারণগত, শ্রুতিগত ও ধ্বনিতরঙ্গগত বিশ্লেষণ করে। আর ধ্বনিতত্ত্ব একটি ভাষার বাগধ্বনিগুলি সেই ভাষায় কীভাবে ব্যবহৃত হয় তা বিশ্লেষণ করে। 

ধ্বনিবিজ্ঞান ও ধ্বনিতত্ত্বে আলোচনার ধরন :

ধ্বনিবিজ্ঞান ধ্বনি বিশ্লেষণ করে –

উচ্চারণগত, ধ্বনিতরঙ্গগত, শ্রুতিগত ।

ধ্বনিতত্ত্ব ধ্বনি বিশ্লেষণ করে –

নির্দিষ্ট ভাষায় ধ্বনির ব্যবহারিক চরিত্র ।

বাগধ্বনি প্রধানত দু-ধরনের- বিভাজ্যধ্বনি ও অবিভাজ্যধ্বনি। বিভাজ্যধ্বনির দুটি মূল ভাগ- স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি। অবিভাজ্যধ্বনির মধ্যে পড়ে দৈর্ঘ্য, শ্বাসাঘাত, যতি ও সুরতরঙ্গ।

স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি 

আন্তর্জাতিকভাবে ভাষাবিজ্ঞানীদের দ্বারা স্বীকৃত মৌলিক স্বরধ্বনি বা Cardinal vowels হল বিভিন্ন ভাষার স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় জিহ্বার অবস্থান ও ওষ্ঠের আকৃতি বুঝিয়ে দেবার মানদণ্ড। অধ্যাপক জোন্স মৌলিক স্বরধনিকে ‘Scales of Cardinal Vowels’ বলেছেন।

মৌলিক স্বরধ্বনিঃ

যে স্বরধ্বনিগুলোকে বিশ্লেষণ করা যায় না তাকে মৌলিক স্বরধ্বনি বলে। মৌলিক স্বরধ্বনি সাতটি।

যথা: অ, আ, ই, উ, এ, ও, অ্যা।

মৌলিক স্বরধ্বনির গুণগত শ্রেণিবিভাগ:

মৌলিক স্বরধ্বনির গুণগত শ্রেণিবিভাগের মানদন্ড হলো তিনটি–

ক) জিহ্বার অবস্থান

খ) মুখবিবরের শূন্যতার পরিমাপ

গ) ওষ্ঠরে আকৃতি

ক) জিহ্বার অবস্থান:

জিহ্বার অবস্থান অনুসারে স্বরধ্বনিকে নিম্নলিখিতভাবে ভাগ করা যায়–

☆ সম্মুখ স্বরধ্বনি: যে স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় জিহ্বা সামনের দিকে অর্থাৎ ওষ্ঠের দিকে এগিয়ে আসে তাকে সম্মুখ স্বরধ্বনি বলে। যেমনঃ ই, এ, অ্যা

☆পশ্চাৎ স্বরধধ্বনি যে স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় জিহ্বা পিছন দিকে অর্থাৎ গলার দিকে গুটিয়ে যায় তাকে পশ্চাৎ স্বরধ্বনি বলে। যেমনঃ অ, ও, উা

★কেন্দ্রীয় স্বরধবনি: সম্মুখ স্বর ও পশ্চাৎ স্বরের মাঝামাঝি অবস্থানে জিভকে রেখে যে স্বরধ্বনি উচ্চারণ করা হয় তাকে স্বরধ্বনি বলে। যেমন: আ

★উচ্চ স্বরধবনি: যে স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় জিহ্বা মুখবিবরের সর্বোচ্চ স্থানে থাকে তাকে উচ্চ-স্বরধ্বনি বলে। যেমনঃ ই

☆উচ্চমধ্য স্বরধ্বনি: জিহ্বা যখন মুখবিবরের সর্বোচ্চ স্থানের তুলনায় সামান্য নিম্নে অবস্থান করে যে স্বরধ্বনির সৃষ্টি করে তাকে উচ্চমধ্য স্বরধ্বনি বলে। যেমনঃ এ,ও।

★নিম্ন স্বরধ্বনি: যে স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় জিহ্বা মুখবিবরের সর্বনিম্ন স্থানে থাকে তাকে নিম্ন স্বরধ্বনি বলে যেমনঃ আ

☆নিম্ন-মধ্য স্বরধ্বনি: জিহ্বা যখন মুখবিবরের সর্বনিম্ন স্থানের সামান্য উপরে এবং সেই সময় যে স্বরধ্বনি উচ্চারণ করে তাকে নিম্ন মধ্য স্বরধ্বনি বলে। যেমনঃ অ, অ্যা

খ) মুখবিবরের শূন্যতার পরিমাপ:

মুখবিবরের ভিতরের শূন্যস্থানের পরিমাপ অনুসারে স্বরধ্বনিকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেমন:

★সংবৃত স্বরধ্বনি: যে স্বরধ্বনি উচ্চারণ করার সময় মুখবিবর কম খোলা থাকে তাকে সংবৃত স্বরধ্বনি বলে। যেমনঃ ই, উা

★বিবৃত স্বরধ্বনি: যে স্বরধ্বনি উচ্চারণ করার সময় মুখবিবর সম্পূর্ণ উন্মুক্ত বা খোলা থাকে তাকে বিবৃত স্বরধ্বনি বলে। যেমনঃ আ

★অর্ধসংবৃত স্বরধ্বনি: যে স্বরধ্বনি উচ্চারণ করার সময় মুখবিবর খুব বেশি কিংবা কম উন্মুক্ত না হয়ে মধ্যবর্তী অবস্থান করে তাকে অর্ধসংবৃত স্বরধ্বনি বলে। যেমনঃ এ, ও।

☆ অর্ধবিবৃত স্বরধ্বনি: যে স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখবিবর সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয় না তাকে অর্ধবিবৃত স্বরধ্বনি বলে। যেমনঃ অ অ্যা

গ) ওষ্ঠের আকৃতি:

ওষ্ঠের আকৃতি অনুসারে স্বরধ্বনিকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়-

☆ প্রসারিত স্বরধ্বনি: যে স্বরধ্বনি উচ্চারণ করার সময় ওষ্ঠ ও অধর প্রসারিত হয় তাকে প্রসারিত স্বরধ্বনি বলে। যেমনঃ ই, এ, অ্যা

☆ কুঞ্চিত স্বরধ্বনি: যে স্বরধ্বনি উচ্চারণ করার সময় ওষ্ঠ ও অধর গোল হয়ে কুঞ্চিত আকার ধারণ করে তাকে কুকুঞ্চিত স্বরধ্বনি বলে। যেমনঃ অ, উ, ও।

বাংলা স্বরধ্বনিগুলির মধ্যে ৭ টি স্বরধ্বনি মৌলিক।

ব্যঞ্জনধ্বনি :

মান্য বাংলায় ব্যঞ্জনধ্বনির সংখ্যা ৩০ টি।

স্পর্শ ধ্বনি- ক্ থেকে ম্ পর্যন্ত পঁচিশটি ধ্বনি।

অল্পপ্রাণ ধ্বনি- বর্গের প্রথম ও তৃতীয় ধ্বনিগুলি। যথা ক্ গ্, চ্ জ্, ট্ ড্, ত্ দ্, প্ ব্।

মহাপ্রাণ ধ্বনি- বর্গের দ্বিতীয় ও চতুর্থ ধ্বনিগুলি। যথা খ্ ঘ্, ছ্ ঝ্, ঠ্ ঢ্, ত্ ধ্, প্ ভ্।

অঘোষ ধ্বনি- বর্গের প্রথম ও দ্বিতীয় ধ্বনিগুলি। যথা ক্ খ্, চ্ ছ্, ট্ ঠ্, ত্ থ্, প্ ফ্।

ঘোষ ধ্বনি- বর্গের তৃতীয় ও চতুর্থ ধ্বনিগুলি। যথা – গ্ ঘ্ , জ্ ঝ্ , ড্ ঢ্ , দ্ ধ্, ব্ ভ্।

নাসিক্য ধ্বনি- প্রত্যেক বর্গের পঞ্চম ধ্বনিগুলি। যথা ঙ্, ঞ্, ণ্, ন্, ম্।

উষ্মধ্বনি শ্, ষ্, স্, হ।

ধ্বনিমূল না সহধ্বনিঃ 

কম্পিত ধ্বনি – র্।

তাড়িত ধ্বনি – ড়, ঢ়্।

পার্শ্বিক ধ্বনি – ল্।

বাংলা উচ্চারণে চারটি অর্ধস্বরধ্বনি আছে। এগুলির জন্য বাংলার কোনো বর্ণ নির্দিষ্ট নেই। খই, বউ, আয়, যাও- এই চারটি শব্দ যে যে অসম্পূর্ণ স্বরধ্বনির উচ্চারণে শেষ হয় সেই চারটি অর্ধস্বর, যদিও বাংলা অর্ধস্বর নিয়েও বিতর্ক আছে।

ধ্বনিমূল ও সহধ্বনি

ধ্বনিতত্ত্বের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হল ধ্বনিমূল ও সহধ্বনি।

ধ্বনিমূল :

বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানে উচ্চারণ বৈচিত্র্যসহ প্রত্যেকটি মূলধ্বনিকে ধ্বনিমূল বলে।

সহধ্বনি :

কোনো নির্দিষ্ট ধ্বনির উচ্চারণ স্থান তার অবস্থান অনুযায়ী বদলে যায় । প্রতিবেশ অনুযায়ী ধ্বনির উচ্চারণভেদকে সহধ্বনি বলে।

অর্থাৎ প্রতিবেশ বিশেষে বাংলা/ল্/-এর তিন রকম উচ্চারণ হয়।/ল/-কে বলে ধ্বনিমূল এবং এর তিন রকম উচ্চারণভেদকে বলে সহধ্বনি।

ধ্বনিতত্ত্বের অন্যতম দায়িত্ব হল ভাষায় উচ্চারিত বিভিন্ন ধ্বনির মধ্যে ধ্বনিমূল ও সহধ্বনি শনাক্ত করা। সূক্ষ্মভাবে বলতে হয় কোন্ ধ্বনিটি কোন্ ধ্বনিমূল পরিবারের সহধ্বনি তা শনাক্ত করা। এই কাজের কয়েকটি পদ্ধতি আছে। এখানে খুব সংক্ষেপে তিনটি উল্লেখ করা হল।

(ক) ন্যূনতম শব্দজোড় :

দুটি ভিন্ন শব্দের মধ্যে উচ্চারণগত ন্যূনতম (একটি মাত্র) পার্থক্য থাকলে, সেই শব্দজোড়কে বলা হয়  ন্যূনতম শব্দজোড়। যেমন :- ‘আম’ ও ‘জাম’।  ন্যূনতম শব্দজোড়ে উচ্চারিত দুটি ধ্বনি ভাষার দুটি পৃথক ধ্বনিমূল। যেমন-তালা-থালা, নরম-গরম, দশক-দমক, দরগা-দরজা, ঝুল-ঝোল, তিল-তেল, ভালো-কালো, দাম-দান।

(খ) পরিপূরক অবস্থান

উচ্চারণগতভাবে মিল আছে এমন যে ধ্বনিগুলি নিজেদের নির্দিষ্ট প্রতিবেশে উচ্চারিত হয়, অর্থাৎ একটির জায়গায় অন্যটি উচ্চারিত হয় না, অর্থাৎ পরিপূরক অবস্থানে থাকে, সেই ধ্বনিগুলি কোনো একটি ধ্বনিমূলের সহধ্বনি হিসেবে শনাক্ত হয়। যেমন ওপরে উল্লিখিত তিন ধরনের/ল্/।

(গ) কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় দুটি ধ্বনি পার্থক্যমূলক অবস্থানে রয়েছে, আপাতবিচারে ন্যূনতম শব্দজোড়ের মতো, কিন্তু জোড়ের শব্দ দুটির মধ্যে অর্থের কোনো পার্থক্য নেই। যেমন, ‘গাঢ়’ শব্দটা কারো উচ্চারণে গাঢ়, আবার কারো উচ্চারণে গাড়। এই তফাতের ওপর প্রতিবেশের কোনো প্রভাব নেই। বরং এটি অভ্যাস বা সামর্থ্য অনুযায়ী যেমন খুশি উচ্চারণ। এই রকম উচ্চারণভেদকে বলে ধ্বনির মুক্ত বৈচিত্র্য

ধ্বনিমূলের অবস্থান ও সমাবেশ

ধ্বনিতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে পড়ে ধ্বনিমূলের অবস্থান ও সমাবেশ। অবস্থান বলতে বোঝায় একটি ধ্বনিমূল শব্দে কোন্ কোন্ অংশে ও কোন্ কোন্ ধ্বনি প্রতিবেশে উচ্চারিত হতে পারে তার খবর। আর সমাবেশ বলতে বোঝায় একটি ধ্বনিমূল আর কোনো কোনো ধ্বনিমূলের সঙ্গে একত্রিত হয়ে যুক্তধ্বনি তৈরি করতে পারে তার খবর।

ধ্বনিমূলের অবস্থান: 

শব্দের নানা অংশ। শব্দ শুরুর মুখটা হল আদ্য, শব্দের একেবারে শেষ অংশটা হল অন্ত্য, বাকি অংশটুকু মধ্য, দুটি স্বরধ্বনির মধ্যবর্তী অংশ হল স্বরমধ্যগত প্রতিবেশ ইত্যাদি। এ ছাড়াও আছে নির্দিষ্ট ধ্বনির প্রতিবেশ, অর্থাৎ আলোচ্য ধ্বনিমূলটির ঠিক পূর্ববর্তী বা ঠিক পরবর্তী ধ্বনিটি কী? অন্যভাবে বলা যায়, আলোচ্য ধ্বনিমূলটি কোন্ কোন্ ধ্বনির পরে বা কোন্ কোন্ ধ্বনির আগে উচ্চারিত হতে পারে।

ধ্বনির সমাবেশ: 

বিভিন্ন ধ্বনির সমাবেশের ফলে বিভিন্ন ধরনের যুগ্মধ্বনি তৈরি হয়। স্বরধ্বনির সঙ্গে অর্ধস্বরের সমাবেশে তৈরি হয় দ্বিস্বরধ্বনি। অর্ধস্বরের জন্যে কোনো বর্ণ নির্দিষ্ট নেই।   চারটি দ্বিস্বরধ্বনি হল [ওউ], [ওই], [অএ], [অও] যেমন উচ্চারিত হয় যথাক্রমে মৌ, কই, হয় ও হও শব্দে।

ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে ব্যঞ্জনধ্বনি সমাবেশে দু-ধরনের যুগ্মধ্বনি তৈরি হয়- গুচ্ছধ্বনি ও যুক্তধ্বনি।

গুচ্ছধ্বনি: 

পাশাপাশি উচ্চারিত দুটি ব্যঞ্জনধ্বনির সমাবেশকে গুচ্ছধ্বনি বলে। যাদের মাঝখানে কোনো স্বরধ্বনি নেই। এই দুই ব্যঞ্জনের মাঝে কোনো স্বরধ্বনি না থাকলেও দলসীমা থাকে, অর্থাৎ দুটি ব্যঞ্জনের প্রথমটি পূর্ববর্তী দলের ও শেষেরটি পরবর্তী দলের অংশ বলে গণ্য হয়।

বাংলায় দুটি ব্যঞ্জনধ্বনির সমাবেশে তৈরি গুচ্ছধ্বনির সংখ্যা ২০০টির বেশি।

তিনটি ব্যঞ্জনধ্বনির সমাবেশেও গুচ্ছধ্বনি তৈরি হয়। যেমন- অস্ত্র ও যন্ত্র শব্দে। তিনটি ব্যঞ্জনধ্বনির সমাবেশে তৈরি গুচ্ছধ্বনির তৃতীয় ব্যঞ্জনটি সদাসর্বদাই [র] এবং বাংলায় এরকম গুচ্ছধ্বনির সংখ্যা ৮টি।

চারটি ব্যঞ্জনধ্বনির সমাবেশে তৈরি গুচ্ছধ্বনি বাংলায় মাত্র ১টি ক্ষেত্রে, তা হল ‘সংস্কৃত’ শব্দটি।

যুক্তধ্বনি: 

যে ব্যঞ্জনধ্বনির সমাবেশগুলি শব্দের আদ্য অবস্থানে বা দলের আদিতে উচ্চারিত হতে পারে সেগুলিকে যুক্তধ্বনি বলে। যুক্তধ্বনির সমাবেশ গুচ্ছধ্বনির তুলনায় বেশি পাকাপোক্ত কারণ এই ধ্বনিগুলির মাঝে কোনো দলসীমা থাকে না। দুই ব্যঞ্জন সমাবেশের যুক্তধ্বনিতে হয় প্রথম ব্যঞ্জনটি [স্], নয়তো দ্বিতীয় ব্যঞ্জনটি [র] বা [ল] হয়। বাংলা শব্দে এই রকম যুক্তধ্বনির সংখ্যা ২৮টি। 

তিন ব্যঞ্জনের সমাবেশে তৈরি যুক্তধ্বনির সংখ্যা ২টি, স্ত্র ও স্পৃ যেমন পাওয়া যায় স্ত্রী, স্পৃহা ইত্যাদি শব্দে।

অবিভাজ্য ধ্বনি :

বিভাজ্য ধ্বনিকে মুখের কথার ধ্বনিপ্রবাহ থেকে কৃত্রিমভাবে হলেও খণ্ড খণ্ড করে বিভাজন করা যায়। যেমন- তুমি কথাটার উচ্চারণের খন্ডগুলি হলো ত্+উ+ম্+ই। কিন্তু ভাষায় আরো কিছু ধ্বনি উপাদান থাকে যেগুলিকে এই রকম কৃত্রিমভাবেও খণ্ড করা যায় না। কারণ এই রকম উপাদানগুলি কোনো বিভাজ্যধ্বনির অংশ নয়, বরং এগুলি একাধিক ধ্বনিখণ্ড জুড়ে অবস্থান করে। এগুলিকে অবিভাজ্য ধ্বনি বলে। বাংলাতেও এই রকম কয়েকটা অবিভাজ্য ধ্বনি আছে। 

নীচে কয়েকটি অবিভাজ্য ধ্বনির পরিচয় দেওয়া হল।

শ্বাসাঘাত: 

শ্বাসাঘাত হল একাধিক দলযুক্ত শব্দের কোনো একটি দলকে অপেক্ষাকৃত বেশি জোর দিয়ে উচ্চারণ করা। বাংলায় সাধারণত শব্দের প্রথম দলটিতে শ্বাসাঘাতের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। যান্ত্রিক নিরীক্ষাতেও প্রথম দলে শ্বাসাঘাতের উপস্থিতি দেখা যায়। শ্বাসাঘাতের উপস্থিতি পুরো দল জুড়ে, কোনো নির্দিষ্ট ধ্বনিতে নয়। তাই এটি অবিভাজ্য ধ্বনি। যেমন- মাখন, আরতি, লোকবল, শব্দের প্রথম দল মা, আ, লোক, শব-এর ওপর শ্বাসাঘাত পড়ে। 

দৈর্ঘ্য: 

দৈর্ঘ্য বলতে সাধারণত বোঝায় দলের উচ্চারণে স্বরধ্বনির দৈর্ঘ্য। বাংলায় বহুদল শব্দের স্বরধ্বনির তুলনায় একদল শব্দের স্বরধ্বনির দৈর্ঘ্য বেশি, ফলে একদল শব্দের দৈর্ঘ্যও বেশি। যেমন- ‘আমার’ শব্দের [আ]-এর চেয়ে ‘আম’ শব্দের [আ] বেশি দীর্ঘ।

যতি: 

যতি হল দল বা শব্দসীমায় অপেক্ষাকৃত লম্বা ছেদ। যেমন, ‘রহিম একা দশজনকে চ্যালেঞ্জ করেছে’ এবং ‘রহিম একাদশজনকে চ্যালেঞ্জ করেছে’। প্রথম বাক্যে ‘একা’ শব্দ উচ্চারণের পরে আমরা যতি ব্যবহার করি, কিন্তু দ্বিতীয়টিতে ‘একাদশজনকে’ যতি ছাড়াই উচ্চারণ করি।

সুরতরঙ্গ: 

বাক্যে সুরের ওঠাপড়াকে সুরতরঙ্গ বলে। যেমন- বিবৃতিবাক্য ‘মিঠু কাল স্কুল যাবে’। এবং প্রশ্নবাক্য ‘মিঠু কাল স্কুলে যাবে?’ এই দুটি বাক্যের উচ্চারণে সুরের ওঠাপড়া দু-রকমের। অর্থাৎ এই দু-ধরনের বাক্যে আমরা নীচের মতো দু-রকমের সুরতরঙ্গ ব্যবহার করি।

বিবৃতিবাক্য – মিঠু কাল স্কুলে যাবে।

প্রশ্নবাক্য –  মিঠু কাল স্কুলে যাবে

একনজরে ধ্বনিতত্ত্ব :

বাংলায় মৌলিক স্বরধ্বনির সংখ্যা : ৭টি

ই – উচ্চ, সম্মুখ, প্রসৃত, সংবৃত

উ – উচ্চ, পশ্চাৎ, বর্তুল, সংবৃত

এ – উচ্চমধ্য, সম্মুখ, প্রসূত, অর্ধ সংবৃত

ও – উচ্চমধ্য, পশ্চাৎ, বর্তুল, অর্ধ সংবৃত

অ্যা – নিম্নমধ্য, সম্মুখ, প্রসূত, অর্ধ বিবৃত

অ – নিম্নমধ্য, পশ্চাৎ, বর্তুল, অর্ধ বিবৃত

আ – নিম্ন, কেন্দ্রীয়, বিবৃত

কেন্দ্রীয় স্বরধ্বনি : ‘আ’

স্পর্শ  ধ্বনি  :  ক্ থেকে ম্ পর্যন্ত পঁচিশটি ধ্বনি।

অল্পপ্রাণ ধ্বনি : বর্গের প্রথম ও তৃতীয় ধ্বনিগুলি। যথা- ক্ গ্, চ্ জ্, ট্ ড্, ত্ দ্, প্ ব্

মহাপ্রাণ ধ্বনি : বর্গের দ্বিতীয় ও চতুর্থ ধ্বনিগুলি। যথা- খ্ ঘ্, ছ্ ঝ্, ঠ্ ঢ্, থ্ ধ্, ফ্ ভ্

অঘোষ ধ্বনি : বর্গের প্রথম ও দ্বিতীয় ধ্বনিগুলি। যথা- ক্ খ্ , চ্‌ ছ্, ট্ ঠ্, ত্ থ্, প্ ফ্

ঘোষ ধ্বনি : বর্গের তৃতীয় ও চতুর্থ ধ্বনিগুলি। যথা – গ্ ঘ্ , জ্ ঝ্, ড্ ঢ্, দ্ ধ্, ব্ ভ্

নাসিক্য ধ্বনি : প্রত্যেক বর্গের পঞ্চম ধ্বনিগুলি। যথা- ঙ্, ঞ্, ণ্, ন্, ম্

কণ্ঠ্যবর্ণ : ক্ খ্ গ্ ঘ্ ঙ্

তালব্যবর্ণ : চ্ ছ্ জ্ ঝ্ ঞ্

মূর্ধন্যবর্ণ : ট্ ঠ্ ড্ ঢ্ ণ্

দন্ত্যবর্ণ : ত্ থ্ দ্ ধ্ ন্

ওষ্ঠ্যবর্ণ : প্ ফ্ ব্ ভ্ ম্

‘ঘোষ’ শব্দের অর্থ-নাদ

‘প্রাণ’ শব্দের অর্থ শ্বাসবায়ু

উষ্ম ধ্বনি : শ্,ষ্, স্, হ্ 

কম্পিত ধ্বনি : র

পার্শ্বিক ধ্বনি : ল্

দন্তমূলীয় বর্ণ : স্

কণ্ঠনালীয় : হ্

তাড়িত অল্পপ্রাণ : ড়্

তাড়িত মহাপ্রাণ : ঢ়্

জিহ্বামূলীয় : ক্ খ্ গ্ ঘ্ ঙ্

ঘৃষ্টধ্বনি : চ্ ছ্ জ্ ঝ্

বিভাজ্য ধ্বনির অপর নাম : খণ্ড ধ্বনি

বাগধ্বনি : দুইপ্রকার

খণ্ডধ্বনিকে বলা হয় : বিভাজ্য ধ্বনি

উচ্চারিত দুটি ব্যঞ্জনধ্বনির সমাবেশকে বলে : গুচ্ছধ্বনি

‘Phonology’ বলতে বোঝায় : ধ্বনিতত্ত্ব

পাশাপাশি উচ্চারিত দুটি ব্যঞ্জনধ্বনির সমাবেশকে বলে : গুচ্ছ ধ্বনি

বিভাজ্য ধ্বনিকে ভাগ করা যায় :দুটি ভাগে

দৈর্ঘ্য, শ্বাসাঘাত, সুরতরঙ্গ, যতি : অবিভাজ্য ধ্বনি

বাংলা উচ্চারণে অর্ধস্বরের সংখ্যা: চারটি

দুটি ভিন্ন শব্দের মধ্যে ন্যূনতম উচ্চারণ পার্থক্য থাকলে তাকে বলে: ন্যূনতম শব্দজোড়

একদলের অন্তর্গত ব্যঞ্জন সমাবেশকে বলে : যুক্তধ্বনি

বাংলায় দুটি ব্যঞ্জনের সমাবেশে তৈরি গুচ্ছধ্বনির সংখ্যা কমপক্ষে : ২০০টি

শব্দের শুরুতে বা শেষে থাকে যে ব্যঞ্জন-সমাবেশ তাকে বলে : যুক্তধ্বনি

তিনটি ব্যঞ্জন-এর গুচ্ছধ্বনি বাংলায় : আটটি

চারটি ব্যঞ্জন-এর গুচ্ছধ্বনি বাংলায়: একটি (সংস্কৃত)

একাধিক দলযুক্ত শব্দের কোনো একটিকে বেশি জোর দিয়ে উচ্চারণ করা হলে তাকে বলে: শ্বাসাঘাত

প্রশ্নোত্তর :

উত্তর – মুখের মান্য বাংলার স্বরধ্বনি ৭ টি এবং ব্যঞ্জনধ্বনি ৩০ টি।

২) মৌলিক স্বরধ্বনি কাকে বলে ?বাংলায় মৌলিক স্বরধ্বনি কয়টি?

উত্তর- যেসব স্বরধ্বনিকে বিশ্লেষণ করা যায় না তাদেরকে মৌলিক স্বরধ্বনি বলে।

বাংলায় মৌলিক স্বরধ্বনির সংখ্যা ৭ টি। যথা – অ, আ, ই, উ, এ, ও, অ্যা

৩) ধ্বনিমূল কাকে বলে ?

উত্তর – বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানে উচ্চারণ বৈচিত্রসহ প্রত্যেকটি মূলধ্বনিকে ধ্বনিমূল বলে।

৪) সহধ্বনি কাকে বলে ?

উত্তর – কোনো নির্দিষ্ট ধ্বনির উচ্চারণ স্থান তার অবস্থান অনুযায়ী বদলে যায় । প্রতিবেশ অনুযায়ী ধ্বনির উচ্চারণভেদকে সহধ্বনি বলে।

৫)  ন্যূনতম শব্দজোড় বলতে কী বোঝ? উদাহরণ দাও।

উত্তর – দুটি ভিন্ন শব্দের মধ্যে উচ্চারণগত ন্যূনতম (একটি মাত্র) পার্থক্য থাকলে, সেই শব্দজোড়কে বলা হয়  ন্যূনতম শব্দজোড়। যেমন :- ‘আম’ ও ‘জাম’।

৬) গুচ্ছধ্বনি কাকে বলে ?

উত্তর – পাশাপাশি উচ্চারিত দুটি ব্যঞ্জনধ্বনির সমাবেশকে গুচ্ছধ্বনি বলে । যেমন উত্তর , এখানে পাশাপাশি দুটি [ত্] উচ্চারিত হয়ে একটি গুচ্ছধ্বনি তৈরি করেছে।

৭) বাংলা ভাষায় দুই ব্যঞ্জনে এবং তিন ব্যঞ্জনে তৈরি গুচ্ছধ্বনির সংখ্যা কয়টি?

উত্তর – বাংলা ভাষায় দুই ব্যঞ্জনে তৈরি গুচ্ছধ্বনির সংখ্যা ২০০ এর বেশি এবং তিন ব্যঞ্জনের সমাবেশে ৮টি।

৮) বাংলা ভাষায় চার ব্যঞ্জনের গুচ্ছধ্বনি দিয়ে তৈরি একটি শব্দের উদাহরণ দাও?

উত্তর – বাংলা ভাষায় চার ব্যঞ্জনের গুচ্ছধ্বনি দিয়ে তৈরি একটি শব্দ হল – ‘সংস্কৃত’।

৯) যুক্ত ধ্বনি কাকে বলে ?

উত্তর – যে ব্যঞ্জনধ্বনির সমাবেশগুলি শব্দ বা দলের আদিতে উচ্চারিত হয় সেগুলিকে যুক্তধ্বনি বলে। যেমন – প্রথম, তৃতীয়, স্কুল ইত্যাদি।

১০) অবিভাজ্য ধ্বনি কাকে বলে ?

উত্তর – যে ধ্বনি উপাদানগুলিকে কৃত্রিমভাবে খন্ড করা যায়না সেগুলিকে অবিভাজ্য ধ্বনি বলে । কয়েকটি অবিভাজ্য ধ্বনি হলো –  শ্বাসাঘাত, দৈর্ঘ্য ,যতি,সুরতরঙ্গ।

১১)  শ্বাসাঘাত কী ? উদাহরণ দাও।

উত্তর – শ্বাসাঘাত হল একাধিক দলযুক্ত শব্দের কোনো একটি দলকে অপেক্ষাকৃত বেশি জোর দিয়ে উচ্চারণ করা। শ্বাসাঘাতের উপস্থিতি পুরো দল জুড়ে, কোনো নির্দিষ্ট ধ্বনিতে নয়। বাংলায় সাধারণত শব্দের প্রথম দলে শ্বাসাঘাতের উপস্থিতি দেখা যায়।

যেমন :-  শব্দ (শব্+দ) ; এখানে  শব্ -এই শব্দটিতে শ্বাসাঘাত পড়েছে।

১২)  দৈর্ঘ্য কী ? উদাহরণ দাও।

উত্তর –  দৈর্ঘ্য বলতে সাধারণত বোঝায়া দলের উচ্চারণে স্বরধ্বনির দৈর্ঘ্য। বাংলায় বহুদল শব্দের স্বরধ্বনির তুলনায় একদল শব্দের স্বরধ্বনির দৈর্ঘ্য বেশি। যেমন :- ‘আমার’ শব্দের ‘আ’ অপেক্ষা ‘আম’ শব্দের ‘আ’-এর দৈর্ঘ্য বেশি।

১৩)  যতি কাকে বলে?

উত্তর – আমাদের বাকপ্রবাহের ধারায় দুটি স্বনিমের মধ্যবর্তী বিরতিকে বা শব্দসীমায় অপেক্ষাকৃত লম্বা ছেদকে, বলা হয় যতি।

১৪) সুর তরঙ্গ কাকে বলে ?

উত্তর- বাক্যে সুরের ওঠাপড়াকে সুরতরঙ্গ বলে । যেমন বিবৃতিবাক্য-  ‘মিঠু কাল স্কুল যাবে’ এবং প্রশ্নবাক্য ‘মিঠু কাল স্কুল যাবে ?’ – এই দুটি বাক্যের উচ্চারণে সুরের ওঠাপড়া দু’রকমের।

Scroll to Top