বাংলা ছাত্রছাত্রীদের পাশে সারাক্ষণ

ভাষাবিজ্ঞান ও তার শাখা-প্রশাখা |ভাষা |দ্বাদশ শ্রেণি |তৃতীয় সেমেস্টার|উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা

দ্বাদশ শ্রেণি |তৃতীয় সেমেস্টার

ভাষাবিজ্ঞান ও তার শাখা-প্রশাখা

ভাষাবিজ্ঞান ও তার শাখা-প্রশাখা :

ভাষার বিজ্ঞানই হল ভাষাবিজ্ঞান। অন্যভাবে বললে, ভাষা নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত চর্চাই হল ভাষাবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য। ভাষাবিজ্ঞান বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতোই নিত্য প্রগতিশীল এবং নিত্য সক্রিয় একটি বিদ্যা (Discipline)। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতোই ভাষাবিজ্ঞানের গতি হল বিশেষ (Particular) থেকে সাধারণের (General)-এর দিকে; এ পদ্ধতি হল আরোহমূলক। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ভাষা সম্পর্কে আলোচনার প্রথম ধাপ হচ্ছে তথ্যসংগ্রহ (Data Collection) ও নথিভুক্তকরণ (Recording)। তারপর সেই প্রাপ্ত তথ্যকে বিশ্লেষণ (Analysis) করে তার যথাযথ বর্ণনা (Objective Description)। 

ভাষাবিজ্ঞান মানুষের মুখের ভাষার চর্চা করে। লিখিত ভাষা ভাষাবিজ্ঞানের আলোচনায় আসে না। লেখা শুরু হয়েছে পাঁচ ছয় কি সাত হাজার বছর আগে। মুখের ভাষাকে লিখন পদ্ধতি কখনো সম্পূর্ণ প্রকাশ করতে পারে না। লিখিত ভাষার বহু সীমাবদ্ধতা আছে। দ্বিতীয় যে কারণে ভাষাবিজ্ঞান কেবল মৌখিক ভাষাকে গুরুত্ব দেয় তা এই যে, যেখানে বহু সহস্র কোটি মানুষ কথা বলে বা মৌখিকভাবে ভাষা ব্যবহার করে, সেখানে তার মাত্র কয়েক শতাংশ মানুষ লিখতে জানে। তাই মুখের ভাষাকেই ভাষাবিজ্ঞানীরা আসল ভাষা বলে মানেন। সুতরাং; ভাষাবিজ্ঞান হল সামগ্রিকভাবে ভাষার (অর্থাৎ মানুষের মুখের ভাষার) গঠন, প্রকৃতি, পদ্ধতি সম্বন্ধে বিজ্ঞানসম্মত চর্চার নাম। 

ভাষাবিজ্ঞান শুধু ভাষার ভিতরের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনাই নয়, ভাষা মানবসভ্যতায় কীভাবে কাজ করে তাও সামগ্রিকভাবে ভাষাবিজ্ঞানের বিষয়।

তুলনামূলক, ঐতিহাসিক এবং বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞান :

ভাষাবিজ্ঞানের আলোচনা নানারকম হতে পারে। তার মধ্যে তিনটি বহুল প্রচলিত শাখা হলো- তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞান, ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান এবং বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞান।

তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞান:

 তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের সূত্রপাত করেছিলেন স্যার উইলিয়াম জোন্স (১৭৮৬)। জোন্স সংস্কৃত, গ্রিক, লাতিন, ফারসি ভাষার মধ্যে প্রচুর মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, এই ভাষাগুলির মধ্যে একটিঐক্যসূত্র আছে কারণ এই ভাষাগুলি একটি মূলভাষা থেকে উৎপন্ন। সেটি হলো ইন্দো-ইয়োরোপীয়। সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে ইয়োরোপ এবং পরবর্তীকালে আমেরিকায় তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের প্রচুর চর্চা হয়। একথা অনস্বীকার্য যে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান চর্চার সূত্রপাত তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞান চর্চার হতে। তুলনামূক ভাষাবিজ্ঞান সমগোত্রজ ভাষাগুলির মধ্যে তুলনা করে এবং তাদের উৎস ভাষাকে বা মূলভাষাকে পুনর্নির্মাণ করে।

ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান:

 প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা কীভাবে বিভিন্ন স্তর যেমন পালি, প্রাকৃত, অপভ্রংশ, অবহট্টর মধ্যে দিয়ে বাংলা ভাষার জন্ম দিয়েছে তা মূলত ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার যে বিবর্তন হয় এবং সেই বিবর্তনের ফলে যে যে পরিবর্তন ভাষার সংগঠনে দেখা যায় তা নির্দেশ করা ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের কাজ। বিশেষ করে শব্দ ও পদমধ্যস্থ ধ্বনি পরিবর্তন ভাষার কালগত রূপান্তরের অন্যতম কারণ। ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান এই ধ্বনি পরিবর্তনের কারণ ও বিভিন্ন ধরনের ধ্বনি পরিবর্তন যা ভাষার মধ্যে ক্রিয়া করে তা অনুসন্ধান করে।

বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞান: 

বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞান সমকালীন প্রচলিত ভাষার গঠনরীতির বিচার বিশ্লেষণ করে। বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের সূত্রপাত হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে প্রধানত ইয়োরোপ এবং পরবর্তীকালে মার্কিন দেশে। যে ভাষার কোনো অতীত নিদর্শন নেই অথবা যে ভাষা এখনও পর্যন্ত লিপিবদ্ধ হয়নি সেই ভাষার আলোচনার জন্য বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের গুরুত্ব অপরিসীম। এই শাখার মতে কোনো ভাষার আলোচনার প্রধান বিষয় চারটি-ধ্বনিবিজ্ঞান ও ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব এবং শব্দার্থতত্ত্ব। ধ্বনিবিজ্ঞান আলোচনা করে কীভাবে বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে ধ্বনিসমষ্টি উচ্চারিত হয়।

ধ্বনিতত্ত্বের আলোচনায় আমরা পাই কোনো একটি বিশেষ ভাষার ব্যবহৃত ধ্বনিগুলির বিচার বিশ্লেষণ। রূপতত্ত্বের বিষয় পদের গঠন, পদের চেয়ে ছোটো ভাষার একক রূপের নানান প্রযুক্তি। বাক্যতত্ত্বের বিষয় হল বাক্যের সার্বিক আলোচনা ও বিচার বিশ্লেষণ। শব্দার্থতত্ত্বের বিষয় শব্দের অর্থ পর্যালোচনা। বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞান ভাষার সংগঠনে আলোচনার উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করে। ভাষাকে যদি মানবদেহের সঙ্গে কল্পনা করি তাহলে ভাষার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি হল ধ্বনি, ধ্বনিগুচ্ছ, রূপ, পদ, বাক্য ইত্যাদি।

ভাষাবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা ও তাদের মধ্যে সম্পর্ক:

 ভাষাবিজ্ঞানের মূল আলোচ্য বিষয় হল মানুষের ভাষা এবং ভাষার সঙ্গে জীবনের বিভিন্ন সংলগ্ন দিকগুলি। ভাষা বাস্তবে একটি অত্যন্ত জটিল বিষয়। ভাষার মধ্যে প্রবেশ করে ভাষার জটিল রহস্যকে উন্মোচন করা ভাষাবিজ্ঞানের অন্যতম উদ্দেশ্য। একদিকে ভাষা এবং অন্যদিকে ভাষার সঙ্গে অন্যান্য সংলগ্ন মানবজীবনের নানা দিক- এই দুই দিক সমান তালে আলোচনা করতে ভাষাবিজ্ঞানের গবেষকদের প্রধানত দু-দলে ভাগ হয়ে যেতে হয়। ক. প্রধান ভাষাবিজ্ঞান ও  খ. ফলিত ভাষাবিজ্ঞান।

প্রধান ভাষাবিজ্ঞান : 

ভাষার কেন্দ্রীয় চরিত্র, বিন্যাস এবং তার গঠন প্রণালী আলোচিত হয়। একে বলে প্রধান ভাষাবিজ্ঞান। 

ফলিত ভাষাবিজ্ঞান :

ভাষার সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক এবং ভাষার সঙ্গে অন্যান্য বিদ্যাচর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রের পারস্পরিক সম্পর্ক বিচার ও বিশ্লেষণ করা হয়। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভাষার অবদান বা প্রয়োগ (application) ফলিত ভাষাবিজ্ঞানের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। 

প্রধান ভাষাবিজ্ঞান ভাষার যে গঠনপ্রণালী বা ভাষার যে কেন্দ্রীয় বিন্যাস আলোচনা করে তা প্রধানত পাঁচটি শাখায় হয়। এই পাঁচটি শাখা হল ধ্বনিবিজ্ঞান (Phonetics), ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology), রূপতত্ত্ব (Morphology), বাক্যতত্ত্ব (Syntax) ও শব্দার্থতত্ত্ব (Semantics)। 

ফলিত ভাষাবিজ্ঞানে আমরা আলোচনা করি বিদ্যাচর্চার বিভিন্ন শাখার সঙ্গে মানবভাষার কী সম্পর্ক। যেমন সমাজ বা সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক যার নাম সমাজভাষাবিজ্ঞান, মানবমনের প্রকৃতি ও গতিপ্রকৃতির সঙ্গে মানব ভাষার সম্পর্ক যার নাম মনোভাষাবিজ্ঞান, মানব মস্তিষ্কের অত্যন্ত জটিল গঠনের ও তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে মানবভাষার সম্পর্ক যার নাম স্নায়ুবিজ্ঞান, নৃতত্ত্বের সঙ্গে মানবভাষার সম্পর্ক যার নাম নৃভাষাবিজ্ঞান প্রভৃতি। সাহিত্য বিশ্লেষণে অথবা সাহিত্যের নান্দনিক দিকটি ঠিকভাবে তুলে ধরতে যে ভাষাবিজ্ঞানের সাহায্য বিশেষ জরুরি সেটি হলো শৈলীবিজ্ঞান। এখানে ভাষা ও সাহিত্যের দিকটি আলোচিত হয়। যে শাখায় অভিধান তৈরিতে ভাষাবিজ্ঞানের প্রয়োগ আলোচনা করা হয় তার নাম অভিধানবিজ্ঞান। 

                   

            ভাষাবিজ্ঞান

ফলিত ভাষাবিজ্ঞান:

সমাজভাষাবিজ্ঞান:

ভাষা কীভাবে সমাজে কাজ করে এবং সমাজ কীভাবে ভাষার ওপর প্রভাব বিস্তার করে, ভাষাবিজ্ঞানের যে শাখাটি এই নিয়ে চর্চা করে তাকেই আমরা সমাজভাষাবিজ্ঞান বলি। এককথায় বলা যায় সমাজভাষাবিজ্ঞান হল ভাষা ও সমাজের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়। 

সমাজভাষাবিজ্ঞানের মূল ভাগ তিনটি

(১) বর্ণনাত্মক সমাজভাষাবিজ্ঞান। (Descriptive Socio linguistics)

(২) পরিবর্তমান সমাজভাষাবিজ্ঞান। (Dyanamic Socio linguistics)

(৩) প্রয়োগমূলক সমাজভাষাবিজ্ঞান। (Applied Socio linguistics)

বর্ণনাত্মক সমাজভাষাবিজ্ঞান : 

বর্ণনাত্মক সমাজভাষাবিজ্ঞান প্রধানত ভাষা বৈচিত্র্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। ভাষার বক্তা, ভাষার বিশেষ রূপ, শ্রোতা, ভাষা ব্যবহারের বিশেষ কারণ-এসব প্রশ্নই বর্ণনাত্মক সমাজভাষাবিজ্ঞানের প্রধান বিবেচ্য। কোনো ভাষার চরিত্র নির্ভর করে বক্তা, (Sender) শ্রোতা (Receiver), এবং উপলক্ষ্য (Setting)- এর ওপর। সুতরাং প্রথমেই প্রয়োজন বক্তার সামাজিক পরিচয়। এরপরে আসে শ্রোতার বা Receiver-এর সামাজিক পরিচয়। বর্ণনামূলক সমাজবিজ্ঞানের তৃতীয় মাত্রা হল উপলক্ষ্য বা Setting। অর্থাৎ পরিস্থিতি বা পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী ভাষা যে পালটে যায়, তা ধরা পড়ে এই অংশের আলোচনায়। সভা সমিতির ভাষা, শ্রেণিকক্ষের ভাষা, ঝগড়ার ভাষা, আইনের ভাষা, খবরের কাগজের ভাষা প্রত্যেকটি ভাষার ধরন আলাদা। উপভাষা অঞ্চলে বাঙালি ছাত্ররা স্কুলে মান্য বাংলা বললেও, বাড়িতে তারা বাংলার কোনো একটি উপভাষাতেই কথা বলেন। সুতরাং, কোথায় কথা বলা হচ্ছে, এটি ভাষার ক্ষেত্রে একটা বড়ো ভূমিকা গ্রহণ করে। এই যে উপলক্ষ্য অনুযায়ী ভাষার বা উপভাষার বদল হয় তাকে সমাজভাষাবিজ্ঞানীরা রেজিস্টার (Register) বলেন। কোনো ব্যক্তির বিশেষ উপভাষার যে বিশেষ রীতি ব্যবহার করে তাকে বলে কোড (code)। সেই ব্যক্তির ভাষা যদি পরিস্থিতি অনুযায়ী বদলে নেয় তবে এই প্রক্রিয়াটিকে বলে কোড-বদল (code-switching)|

পরিবর্তমান সমাজভাষাবিজ্ঞান :

সচল বা পরিবর্তমান সমাজভাষাবিজ্ঞান সমাজভাষাকে মূলত ইতিহাসের দিক থেকে দেখে। কোনো বিশেষ সমাজ ভাষার উদ্ভব বিবর্তন বিস্তার ও সংকোচনের ধারা নিয়ে ভাষা-বিজ্ঞানের এই শাখাটি কাজ করে। দ্বিভাষিকতা বা Bilingualism,ক্রেওল এবং পিজিনের কথা এই ভাগের মধ্যে পড়ে।

প্রয়োগমূলক সমাজভাষাবিজ্ঞান : 

 মাতৃভাষা শেখানোর পদ্ধতি, অন্য ভাষা শেখার পদ্ধতির উদ্ভাবন, অনুবাদনীতি, লিপি প্রণালীর উদ্ভাবন, পরিমার্জনা ও সংশোধন, বানান সংস্কার, ভাষা পরিকল্পনার দিক থেকে রাষ্ট্রভাষা ও সংযোগের ভাষা ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এসবই প্রয়োগমূলক সমাজভাষাবিজ্ঞানের অন্তর্গত।

মনোভাষাবিজ্ঞান: 

ভাষার সঙ্গে মনের যোগ নিবিড়। মনোভাষাবিজ্ঞানীরা ভাষা ও মনের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা করেন। মনোভাষাবিজ্ঞান সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে শিশুর ভাষার ক্ষেত্রে; কীভাবে তারা কথা বলে, কীভাবে বাক্য তৈরি করে তার ধারাবাহিক বিশ্লেষণ করে মনোভাষাবিজ্ঞান।

মানুষ কীভাবে ভাষা শেখে এ সম্পর্কে  প্রাথমিক অনুমান ছিল যে মানুষ ভাষিক পরিবেশে থেকে অনুকরণের মাধ্যমে ভাষা আয়ত্ত করে। নোয়াম চমস্কি এই তত্ত্বের থেকে সরে এসে বললেন যে মানুষের মধ্যেই থাকে ভাষা শেখার সামর্থ্য। মানব মস্তিষ্কেই রয়েছে সেই সামর্থ্যের কেন্দ্র। সে-কারণে চমস্কি প্রথমে মস্তিষ্ককে বললেন ভাষা শেখার যন্ত্র বা (Language Acquisition Device (LAD)। পরে তিনি ‘যন্ত্র’ কথাটির পরিবর্তে ‘ব্যবস্থা’ বা (System) কথাটি ব্যবহার করলেন। তাঁর মতে মানব মস্তিষ্কে প্রি-প্রোগ্রামড অবস্থায় আছে এমন এক

ব্যাকরণ যাকে সর্বজনীন ব্যাকরণ বা (Universal Grammar) বলে চিহ্নিত করেন। এই (LAD-LAS)-এর মাধ্যমেই শিশুরা ভাষাশিক্ষায় অনুকরণধর্মিতা থেকে সৃষ্টিশীলতার এক বিশাল ভান্ডারে পৌঁছেছে।

বিভিন্ন প্রকার ভাষাগত পশ্চাদপরতা (Language disorder), স্মৃতির অবনতি সেগুলি মনোভাষাবিজ্ঞানের পাশাপাশি স্নায়ুভাষাবিজ্ঞানেরও বিষয়।

স্নায়ুভাষাবিজ্ঞান: 

 ভাষার সঙ্গে মানবমস্তিষ্কের সম্পর্ক এবং ভাষাব্যবহারগত সমস্যা-এই দুই-ই স্নায়ুভাষাবিজ্ঞানের আলোচনার মধ্যে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত অসুস্থ মানুষের ভাষা ব্যবহারের সমস্যা এবং স্নায়ুবিক বিক্ষোভের চর্চায় ভাষাব্যবস্থায় মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের পৃথক দায়িত্ব এবং মস্তিষ্ক বিকাশের সঙ্গে ভাষাগত দক্ষতার সম্পর্ক নিয়ে বহু অজানা বিষয় নিত্যনতুন গবেষণায় জানা যাচ্ছে। পরোক্ষভাবে মস্তিষ্ক কীভাবে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে ভাষার প্রয়োগ করে তাও বুঝতে পারা যায় স্নায়ুভাষাবিজ্ঞানের দৌলতে। প্রযুক্তিও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ফাংশনাল নিউরো-ইমেজিং বা ব্যবহারিক স্নায়ুচিত্রণে আজকাল Positron Emission Tomography (PET) বা Functional Magnetic Resonance Imaging (FMRI) জাতীয় তন্ত্রের ব্যবহার হয়। এই সমস্ত আধুনিক যন্ত্রের কল্যাণে ভাষাবিজ্ঞানের এই শাখাটি প্রতিদিনই বিবর্তিত হয়ে চলেছে।

১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে পল ব্রোকা অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সোসাইটি অফ পারি-তে এক রোগীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন যিনি একুশ বছর ‘তাল’ ধ্বনি ছাড়া কিছুই উচ্চারণ করতে পারতেন না। এই মানুষটির চিকিৎসা প্রসঙ্গেই ক্রমে জানা গেল ভাষাসিদ্ধ যুক্তিক্রম, পরিকল্পনা, আত্মপ্রকাশ, বাচিক সৃজন ক্ষমতা তথা ভাষার মৌলিক বিষয়গুলি, অর্থাৎ অনুভব ও জ্ঞান আহরণ, বলা, পড়া, লেখা- সবই মস্তিষ্কেরই বিভিন্ন অংশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কিত।

 

ভাষার সৃষ্টিতে, প্রয়োগে এবং সংযোগ স্থাপনে মস্তিষ্কের বাম গোলার্ধ বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে নানা ধারাবাহিক গবেষণায় মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অঞ্চলের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে শাখায় মানবশরীরে ভাষার প্রকৃতি ও গঠনগত অবস্থান নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকে স্নায়ুভাষাবিজ্ঞান (Neuro linguistics) বলে। স্নায়ুভাষাবিজ্ঞান আসলে বৌদ্ধিক স্নায়ুভাষাবিজ্ঞানেরই একটি শাখাবিশেষ। আজকের বিজ্ঞানীরা একমত যে মানুষের মস্তিষ্কের বামগোলার্ধের সুনির্দিষ্ট স্নায়ুর গঠন ভাষা এবং কথার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।

স্নায়ুভাষাবিজ্ঞান শুধুমাত্র ভাষা নিয়েই চর্চা বা গবেষণা করে না তার সঙ্গে ভাষার ব্যবস্থাগত (Systemic), চলন (movement), ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য (Sensory) এবং কোশীয় (Cellular) এবং অন্যান্য নানা বৃহত্তর শাখার সাথে সম্পৃক্ত। স্নায়ুভাষাবিজ্ঞানকে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।

১। ভাষা শেখা (Language acquisition) এবং প্রক্রিয়াকরণ (Processing)

২। ভাষাগত সমস্যার সংস্কার (Language inpairment)

মস্তিষ্ক কীভাবে আমাদের ভাষা এবং কথার বিকাশে সাহায্য করে তা নিয়ে নানা গবেষণা আছে। মস্তিষ্ক ভাষায় এন-কোডিং এবং ডি-কোডিং নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনেই হয়। এ ব্যাপারে মস্তিষ্কের থ্যালামাস বেসাল গ্যাংলিয়া ও ধূসর বস্তু Grey Matter অঞ্চল বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে।

স্নায়ুবিজ্ঞানের ধারাবাহিক চর্চার মধ্যে দিয়ে স্নায়ুভাষাবিজ্ঞান সমৃদ্ধ হয়েছে। ভাষার সৃষ্টি, প্রয়োগ এবং তার সংস্কারের নানাদিক নিয়ে ধারাবাহিক চর্চার অবকাশ রয়েছে স্নায়ুভাষাবিজ্ঞানে।

নৃভাষাবিজ্ঞান: 

ভাষার উৎপত্তি ভাষাবিজ্ঞানীদের কাছে আজও রহস্যে ঢাকা। মানুষের বিবর্তনের বিভিন্ন ধাপের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার উৎপত্তি ও তার বিবর্তন ঘটেছে। ভাষার গঠনের সঙ্গে সমাজ ও সংস্কৃতির যোগ আছে, যোগ আছে সামাজিক সংস্কার ও বিশ্বাসের সঙ্গেও। প্রতিটি সভ্যতা তাদের নিজের মতো করে ব্যবহার্য জিনিসকে চিহ্নিত করে। এর ফলে ভাষার মধ্যে সৃষ্টি হয় নানা বৈচিত্র্য। 

পৃথিবীতে এমন অনেক ভাষা আছে যাদের কোনো লিপি নেই। সেইসব ভাষাও যে আলোচনা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে তা ভাষাবিজ্ঞান বুঝতে পেরেছে নৃতত্ত্বের সংস্পর্শে এসে। পৃথিবীর এই আদিম জনজাতির ভাষার বিশ্লেষণে ভাষাবিজ্ঞান মনোযোগ দিয়েছে বিশ শতকের প্রথম দিক থেকে। মুখের ভাষায় তথ্য সংগ্রহ ও বিচারবিশ্লেষণ তখন থেকে গুরুত্ব পেতে

থাকে। এর ফলে ভাষাবিজ্ঞানের পরিধি বিস্তার লাভ করে এবং ভাষাবিজ্ঞানীদের কাছে নূতন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। নৃতত্ত্বের সঙ্গে মেলবন্ধনের ফলেই ভাষাবিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন যে কোনো ভাষা উন্নত বা অনুন্নত বা মিষ্টি বা কর্কশ এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল, সব ভাষাই সমান ও গুরুত্বপূর্ণ।

শৈলী বিজ্ঞান: 

মানুষের মনের ভাব প্রকাশিত হয় ভাষার মাধ্যমে। কিন্তু এই ‘ভাষার মাধ্যমে’ বলতে বোঝায় ভাষার বিশিষ্টতা। ভাষার এই বিশিষ্টতার আলোচনায় ভাষার রূপ বা form অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই form বা রূপ আসলে লেখকের লেখার শৈলীর ওপর নির্ভর করে। কোনো লেখকের লেখার এই শৈলী বিশ্লেষণকেই আসলে Stylistics বা শৈলী বিজ্ঞান বলা হয়।

আমাদের মনে রাখতে হবে শৈলী বিজ্ঞানের নিরিখ হল প্রয়োগ নির্ভর। অর্থাৎ কোনো লেখক বা সাহিত্যিকের পাঠবস্তু বা Text এবং সেই Text-এর প্রয়োগ রীতি এবং কৌশলই একমাত্র বিবেচ্য। শৈলীবিজ্ঞানের দিক থেকে লিখন শৈলীর বিচার হলো Objective বা নৈর্ব্যক্তিক বিচার। কোনো Text বা পাঠবস্তুর গোড়ার কথা হলো ভাষারীতি। স্যামুয়েল ওয়েসলি (Samuel Wesley) একেই বলেছেন ‘চিন্তার পোশাক’ বা ‘the dress of thought’। এর মানে কোনো একজন লেখক তার চিন্তাভাবনাকে যে ভাবে সাজিয়ে ভাষার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেন।

Style বা শৈলী বিভিন্ন রকমের হলেও, প্রথাগত ভাবে একে দু-ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। প্রথমটি Evaluative বা মূল্যায়নভিত্তিক, আর দ্বিতীয়টি Descriptive বা বর্ণনামূলক। মূল্যায়নভিত্তিক শৈলী আসলে কোনো লেখার শৈলীর বৈশিষ্ট্যসমূহের প্রকাশ। অন্যদিকে বর্ণনামূলক শৈলী হল কোনো লেখকের লেখার শৈলীর বিবরণ বা বর্ণনা। প্রথমটি দ্বারা বঙ্কিমচন্দ্রের লেখনীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের লিখন শৈলীর পার্থক্য নিরূপণ করা যায়। দ্বিতীয়টির সাহায্যে রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের সঙ্গে ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের শৈলীর তফাত সূচিত করা যেতে পারে।

ফেদিনাঁ দ্য সোস্যুর ভাষার নানা উপাদান (ধ্বনি, রূপ বা শব্দাংশ, বাক্য ইত্যাদি) এবং তাদের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কের মূল সংবিধি, ভাষার বিভিন্ন উপাদান ও উপাদানগুলির পারস্পরিক সম্পর্কের জালবিন্যাসকে নাম দিয়েছিলেন লাঙ্ (Langue) পারোল (Parole) হল সেই সংবিধিকে মান্য করেও ভাষা ব্যবহারের উপাদান নির্বাচন ও প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে নিজস্ব একটি বিন্যাসে স্পষ্ট ও প্রকট বাচনক্রিয়া। এই যে বহুবিন্যাসের সম্ভাবনার মধ্যে একটি সম্ভাবনাকে বেছে নেওয়া-এইটিই শৈলীর গোড়ার কথা। সেই অর্থে শৈলীর বিষয়টি পারোলের এক্তিয়ারেই চলে আসবে।

শৈলীর মূলে রয়েছে রচনাকারের নির্বাচন। শৈলীকে সচরাচর যে মতাদর্শগুলির আলোয় দেখা হয় সেগুলিকে পর্যালোচনা করলে এই কথাটিই প্রমাণ হয়। ‘স্টাইল হল প্রচলিত আদর্শ থেকে বিচ্যুতি’ কিংবা ‘স্টাইল হল এক ধরনের বিন্যাসের পুনরাবৃত্তি বা সমাহার, কিংবা স্টাইল হল ব্যাকরণের সম্ভাবনার বিশেষ নিষ্কাশন’-উক্তিগুলির মধ্যে সর্বত্রই রচয়িতার নির্বাচনের প্রক্রিয়াটির গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যে মুহূর্তে রচনার পরিণামী প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে সচেতনতা তৈরি হয়, তখনই এসে পড়ে নির্বাচনের প্রসঙ্গ। ভাষাবিজ্ঞানী মিলিচ একে বলেছেন ‘rhetorical choice’ বা আলংকারিক নির্বাচন। 

শৈলী বিচার করার ক্ষেত্রে যে প্রকরণ বা toolগুলি ব্যবহৃত হয় সেগুলি হল 

১. foregrounding বা প্রমুখন, 

২. deviation বা বিচ্যুতি, 

৩. Parallelism বা সমান্তরালতা, 

৪. Code Switching বা কোডবদল বা সংকেতবদল এবং 

৫. Polyphony বা বহুস্বরতা বা বহুধ্বনিময়তা।

একটি ভাষারীতির মধ্যে অন্যরীতির শব্দ বা বাক্যখণ্ড ব্যবহারকে কোড বদল বা সংকেত বদল বলে। বাংলা বলতে বলতে ইংরেজি শব্দ বা বাক্যখণ্ড ব্যবহার, এক উপভাষায় কথন বা উক্তির মধ্যে অন্য উপভাষার প্রয়োগ- প্রভৃতিকে কোডবদলের দৃষ্টান্ত বলা যেতে পারে। উপন্যাস বা মহাকাব্য ও অন্যান্য আখ্যানে বহু শ্রেণির বহুবিচিত্র স্বভাবের, অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিবেশ থেকে আগত বহু চরিত্রের সমাগম ঘটে। এই ভাবেই চরিত্রগুলি ভিন্ন ভিন্ন স্বরকে প্রতিষ্ঠা করে এবং এই স্বরগুলির জটিল বিন্যাসে গ্রথিত হয় উপন্যাস বা মহাকাব্যের কথাবিশ্ব। মিখাইল বাখতিন এই বিষয়টিকেই ‘বহুস্বরিতা’ আখ্যা দিয়েছেন।

 

অভিধানবিজ্ঞান :

ভাষাবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হল অভিধান বিজ্ঞান (Lexicography)। ভারতে অভিধান রচনার সূত্রপাত যাস্কের ‘নিরুক্ত’ থেকে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ‘অভিধান’ বোঝাতে জন গারল্যান্ড প্রথম ‘Dictionarius’ শব্দটি ব্যবহার করেন। ১৫৩৮ সালে ইংরেজি ‘Dictionary’ শব্দটি পাওয়া যায় স্যর থমাস এলিয়েটের ল্যাটিন-ইংরেজি অভিধানে।

ভাষাবিজ্ঞানের দিক থেকে আদর্শ অভিধানে প্রতিটি entry বা শব্দের তিন স্তর থাকবে ১. শব্দের গঠনগত স্তর, ২. অন্বয়গত স্তর এবং ৩. বাগার্থগত স্তর। তৃতীয় স্তরটি অভিধানের দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

অভিধান অনেকরকম হয়। তার মধ্যে অতি পরিচিত হল একভাষিক ও দ্বিভাষিক অভিধান। যেখানে এক ভাষার শব্দকে সেই ভাষাতেই ব্যাখ্যা করা হয়, তা হল একভাষিক অভিধান। যেমন, বাংলা থেকে বাংলা, ইংরেজি থেকে ইংরেজি। যখন এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় ব্যাখ্যা করা হয়, তখন তা দ্বিভাষিক অভিধান। যখন কোনো অভিধানে একটি শব্দের প্রথম প্রচলনের সময়, প্রথম প্রচলনের সময়ে তার কী অর্থ ছিল, কীভাবে অর্থ বদল গঠন, সাম্প্রতিকতম রূপ বা অর্থ কী-এই সব থাকে, তখন তাকে ইতিহাসভিত্তিক অভিধান বলা হয়। যেমন- The Shorter Oxford English Dictionary। এছাড়াও আরেক রকমের অভিধান হল বিষয়-অভিধান যেখানে কোনো বিষয়ের নানা কিছু অভিধানের মতো করে সাজানো ও ব্যাখ্যা করা থাকে। যেমন ইতিহাস অভিধান, অর্থনীতির অভিধান, উদ্ভিদবিদ্যার অভিধান ইত্যাদি।

তথ্যসূত্র : বাংলা ভাষা ও শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির ইতিহাস (পশ্চিমবঙ্গ উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ)

Scroll to Top